২৬শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিকাল ৫:৫৪
২৬শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিকাল ৫:৫৪

ড.ইউনুস সফল ড.ইউনুস বিফল – মাহবুবুল কারীম সুয়েদ।

Share Option;

১-আওয়ামীলীগ নিষিদ্ধের সুত্র ধরে কয়দিন সেনাবাহিনী প্রধানের সাথে সরকারের হাল্কা মধুর ঝামেলার ঘটনা দেখে আমার মত অনেকেই বেশ হতাশায় পড়েছিলেন।আবার বিএনপিও ধারাবাহিকভাবে নির্বাচন এবং অন‍্যান‍্য ইস‍্যুতে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছিল দেখে হতাশা বাড়ছিল।সেইসবকে অতি সাদামাটাভাবে সরকার প্রধান প্রফেসর ইউনুস সাহেব কাটিয়ে দিয়েছেন।পালিয়ে যাওয়া ফ‍্যাসিবাদিদের জন‍্যে আবারো হতাশা বৈ কিছু নেই।যে শেখ হাসিনা বারবার বলতেন “এমন আইন করেছি যে আর কোনদিন কোন মিলিটারি ক্ষমতা নেবার সাহস করবেনা” তারাই এখন মিলিটারি ক‍্যু এর জন‍্যে মোনাজাত ও আহাজারি করছে অবিরত।

২-প্রফেসর সাহেব কোন যাদুর বলে সবাইকে বশ করলেন? সিম্পল উত্তর হচ্ছে ক্ষমতা ছেড়ে দেবার উন্নত মানসিকতা।তার সরকার ক‍্যান্টনমেন্টে জেনারেল ওয়াকারের বক্তব্যের পর পরিস্কার করে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে বিবৃতি দিয়েছে যে,সরকারের ওপর সরকার চলতে দেবনা।তিনিও পরিস্কার বলেছেন যদি কেউ চালাতে চায় বা চাপ দেয় তাইলে আমি দায়িত্ব ছেড়ে দেব।এই দায়িত্ব ছেড়ে দেব বাক‍্যটাও আমাদের মত দেশের আম জনতার জন‍্যে অম্রিতসম বাক্য।সচরাচর কেউ এমনটি বলেনা।জুতোপেটা করে ঠেনে হেচড়ে ক্ষমতা থেকে নামানো যায়না।সর্বশেষ পলাতক প্রধানমন্ত্রী হাসিনার উদাহরণ তো চোখের সামনে।সেই জায়গায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ডক্টর মোহাম্মাদ ইউনুসের এই এক কথায় সব মহলই ঠান্ডা হয়ে গিয়েছেন।

৩- গতকাল প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে।জাতীয় ঐক‍্যমত কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা এতে সভাপতিত্ব করেন যেখানে গঠিত কমিশনগুলোর অন‍্যান‍্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।বৈঠকে উপস্থিত সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিবৃন্দ প্রানবন্ত ও যৌক্তিক কথা বলেছেন।সবার কথাতেই ছিল এক ধরনের ঐক্যের আভা।এটি যেন একই গন্তব‍্যে যাত্রা করা ভিন্ন ভিন্ন গাড়ির মত।যার যার মতামত ভিন্ন, আদর্শ ভিন্ন, কর্মকৌশল ভিন্ন কিন্তু ফ‍্যাসিবাদ প্রশ্নে সবাই এক কাতারে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষেত্রে সবার অবস্থান পরিষ্কার।গতকালের বৈঠকের পর আজকে আবারো সবাই ঐক‍্যমত কমিশনের সাথে বৈঠকে বসেছেন।দেশ, গনতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন, আইনের শাসন, সংবিধান, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ও মুল‍্যবোধ রক্ষায় এই দুই দিনের চলমান ঘটনাপ্রবাহ দেখে আমি আশায় বুক বাঁধছি।নোবেল লরিয়েট ৮৫র উর্ধ্ব মানুষটির হাত ধরে নবযুগে দেশ যাত্রা করছে বলে বিশ্বাস জন্মেছে।

৪-প্রফেসর ইউনুস বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় ও ফোরামে বক্তৃতা দিয়েছেন সারাজীবন।তাঁর বক্তৃতা শুনার জন‍্যে প্রাজ্ঞ‍্যরা টাকা খরচ করে অডিটোরিয়ামে ঢুকে।তাকেও বড় অংকের সম্মানী দেয়া হয়।তো যেই মানুষ সারা জীবন মানুষকে কথা মালায় ভালো ও কল‍্যানের কথা বলেছেন তার হাত ধরে তার জীবনের পড়ন্ত বেলায় নিজ দেশ ভালো কিছু পেতে যাচ্ছে তার আশা করাটা অন‍্যায় বা অবাস্তব কোন স্বপ্ন নয়।তিনি আমাদের স্বপ্নগুলোকে কঠিন কঠিন বাস্তবতা, নানা প্রতিবন্ধকতা, প্রতিবেশী দেশের ধারাবাহিক নানা চক্রান্ত ও চাপ, পালিয়ে যাওয়া ফ‍্যাসিবাদীদের অব‍্যাহত ষড়যন্ত্র ইত্যাদি ঠান্ডা মাথায় মোকাবেলা করে তিনি আমাদের বলা যায় মোটামুটি একটা ভালো ইতির দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।সময় হলেই ফুল ফুটবে বলে বিশ্বাস করছি।

৫-ছাত্র আন্দোলনের মুখে হাসিনা দলবলসহ এমনকি মসজিদের খতিব থেকে নিয়ে যাত্রাপালার লীগপন্থী নর্তকী পর্যন্ত পালিয়ে যায় গত বছর জুলাই বিপ্লবের সময়।হাসিনাসহ তার দলের সিংহভাগ সিনিয়র নেতারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছে।কিছু কিছু সাবেক এমপি মন্ত্রী ইউরোপ-আমেরিকায় পালিয়েছে।বলা যায় প্রকাশ‍্যে দেশে বসে এখন আর কেউ আওয়ামীলীগের “আ” শব্দ উচ্চারণের দুঃসাহস দেখায়না। কঠিন এক সময়ে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রনেতারা যারা সমন্বয়ক হিসেবে পরিচিত ‍তারা তৎকালীন সময়ে অলিম্পিক উদ্ভোধন করতে আসা বাংলা মায়ের সুর্য‍্য সন্তান ও একমাত্র নোবেল বিজয়ী ডঃ ইউনুসকে সরকার প্রধানের গুরু দায়িত্ব গ্রহণের আহবান জানায়।এতবড় বিপর্যয়ের পর একটি বিধ্বস্ত প্রায় দেশের সরকার প্রধানের দায়িত্ব গ্রহনের মত চ‍্যালেন্জ কাধে নিয়ে তিনি দেশে ফিরেন।আমাদের আশা ছিল তিনি হতাশ করবেননা এবং তিনি তা করছেনও না।আমরা আশাবাদী ভালোর দিকে যাচ্ছি বলে।তিনি ভালো কিছু আমাদের দিতে যাচ্ছেন এর প্রকাশ ও প্রস্ফুটন হয়েছে ইতিমধ্যে।

৬- দায়িত্ব নেবার পর পর অর্থনীতিকে লাইনে আনা, বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সরকার ও দেশের বিভিন্ন অর্গানগুলোকে নিয়মিত সচল রাখার গুরু দায়িত্ব তিনি সাধ‍্যমত আন্জাম দিয়েছেন।সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর কৌশল, বন‍্যা, রমজানে বাজারমূল্য ইত্যাদিকে তিনি মোকাবেলা করে বলা যায় সফলতার মুখ দেখিয়েছেন।ইতিমধ্যে প্রধান বিচারপতি থেকে নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ নানা পর্যায়ের পদগুলোতে যোগ‍্য মানুষদের পদায়ন করেছেন।বিদেশ থেকে নানা এক্সপার্টদের দেশে ডেকে পাঠিয়েছেন।তাদেরকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে সাধ‍্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছেন।দলহীন নিপীড়িত জনতার প্রতিনিধি হিসেবে তার সরকার কাজ করছে।ভোট বিহীন হলেও জনতাই তার ম‍্যান্ডেট।গনআন্দোলনের ম‍্যান্ডেটকে ধারন করে তিনি জুলাই বিপ্লবের গনআকাংখাগুলোকে একে একে পুরনের পর তার সম্মানজনক বিদায়ের পথ করছেন বলে মনে হচ্ছে।

৭-মোটা দাগে অর্জন সমুহ নিয়ে ভাবলে বেশ কিছু বিষয়ের উল্লেখ করতেই হয়।প্রথমত তার সরকার বিগত রেজিমের প্রধান হাতিয়ার ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে।এরপর ফ‍্যাসিবাদীদল হিসেবে আওয়ামীলীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও আদালতের কাছে বাকি সিদ্ধান্তের দায়িত্ব হস্তান্তর করেছে যা বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল।শহীদ হওয়া শতশত মানুষ, আহত পঙ্গুত্ব বরণ করা হাজার হাজার অসহায় বনি আদমের এই গনপ্রত‍্যাশাকে ইতিমধ্যেই বাস্তবে রুপ দিয়েছেন।এবার সব রাজনৈতিক দলের সবার সম্মতিতে জুলাই ২০২৫র ভেতর “জুলাই সনদ” আসছে যেখানে সব রাজনৈতিক দলের সিগনেচার থাকবে।সাংবিধানিক সংস্কারে মোটামুটি সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে করা হচ্ছে যার স্পষ্ট উল্লেখ গত দুইদিন প্রধান দল বিএনপি ও জামায়াসহ সবাই করেছে।যদি জুলাই সনদ, সাংবিধানিক সংস্কার হয়ে যায় তাই স্বল্প মেয়াদী এই সরকারের এবং সরকার প্রধান হিসেবে প্রফেসর ইউনুসের অর্জন হবে আকাশসম এবং ইতিহাসের বরপুত্র হিসেবেই তার নাম লেখা থাকবে।

৮- হাসিনাগংদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার শুরু হয়েছে।খোলামেলা এবং লাইভ টেলিভিশনে সম্প্রচারের মাধ্যমেই তাদের অপরাধের বিচার হচ্ছে।উপমহাদেশের ইতিহাসে কোন সরকার প্রধানের বিপক্ষে এমন ওপেন ট্রায়ালের নজির নেই।বিচারে হাসিনাগংরা দোষী সাব্যস্ত হবে ইনশাআল্লাহ।তাদের বিচার দুনিয়া দেখছে।ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসতে চাইবে তাদের জন‍্যে এই উদাহরণ থেকে যাবে আর ইতিহাসের পাতায় হাসিনার ঘৃণ্য অপকর্মগুলে নিন্দনীয় হয়ে থাকবে।সরকার প্রধানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ইতিমধ্যেই স্বয়ং জাতিসংঘ থেকে তদন্ত করে জুলাই হত্যার বিস্তারিত রিপোর্ট সামনে এসেছে যা সাইডে ফেলে রাখার কোন সুযোগ নেই।বলা যায় জাতিসংঘের রিপোর্ট প্রকাশের পর থেকে হাসিনার রাজনৈতিক অপমৃত্যু হয়ে গিয়েছে।তার ভাগনী রেহানা কন‍্যা টিউলিপের মন্ত্রীত্বও ইতিমধ্যে চলে গিয়েছে।পাচার হওয়া সম্পদ দেশে ফেরত যাবার ব‍্যাবস্থাও হচ্ছে।ইতিমধ্যেই শেখ রেহানার সম্পদ যা সালমানের ছেলের নামে করা ছিল সেই ৯০ মিলিয়ন পাউন্ডের ফ্ল্যাট বৃ্টিশ অথরিটি জব্দ করেছে।এইসবই সম্ভব হয়েছে একজন প্রফেসর ইউনুসের কারনে।তিনি একটি অবাধ, সুষ্ট ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে স্বসম্মানে বিদায় নিন তা প্রত‍্যাশা করছি।ভবিষ্যতে সরকার যাতে আমাদের জাতির এই সম্পদকে কাজে লাগায় সেই আশাবাদ রাখছি।

লেখকঃ মাহবুবুল কারীম সুয়েদ
যুক্তরাজ‍্য প্রবাসী কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।


Share Option;

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *