
নেত্রকোণা জেলার খালিয়াজুরি উপজেলার খালিয়াজুরি মৌজায় সদর খালিয়াজুরি দিঘল হাটিতে একটি পুরাকীর্তি আছে। স্থানীয়দের ধারণা এটি ব্রিটিশ আমলে নির্মাণ করা হয়েছিল। এই পুরাকীর্তির কোনো লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায়নি তাই স্থানীয় জনশ্রুতির আলোকে নেত্রকোণা জেলার ইতিহাস গ্রন্থে আলী আহাম্মদ খান আইয়োব লিখেছেন- খালিয়াজুরি বাজারে নির্মিত যে এক সুউচ্চ ইমারত প্রদর্শিত আছে, পূর্বে তার চুড়ায় বসে জল দস্যুদের নৌযোগে চলাচলের গতিবিধি দেখা হতো। প্রয়োজনে সেখানে বসে সর্ব সাধারণকে সতর্ক করে দেয়া হতো। একই গ্রন্থের ১৮৬ পৃষ্টায় এই পুরাকীর্তিকে পর্যবেক্ষণ ইমরাত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অপরদিকে অহীন্দ্র নাথা হোম চৌধুরী তাঁর খালিয়াজুরী হোম চৌধুরী বংশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস গ্রন্থের ৬৪ পৃষ্টায় ঐ পুরাকীর্তির ছবি ছাপিয়ে রাধাকৃষ্ণ মন্দির বলে দাবী করেছেন। তিনি একই বইয়ের ২৭ পৃষ্টায় লিখেছেন- দিঘল হাটির ছোট বাড়িতে বসবাসকারি হোম বংশীয়দের নির্মিত একটি মন্দির/মঠ ভগ্ন অবস্থায় খালিয়াজুরী হোমবংশীদের স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে বিরাজ করছে। খালিয়াজুরীতে উক্ত বংশের কোন ভক্ত দ্বিতল ইষ্টক নির্মিত মন্দির নির্মান করতঃ রাধাকৃষ্ণ মুর্তি স্থাপন করিয়া প্রচুর দেবোত্তর সম্পত্তি প্রদান করিয়া গিয়াছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত মোঃ হাফিজুর রহমান ভূঞার বই ময়মনসিংহের জমিদারি ও ভূমিস্বত্ব ১৮৫৪-১৯৬০ এর ১০৭ পৃষ্টায় খালিয়াজুরি সম্পর্কে যা লিখেছেন তা থেকে জানাযায়, খালিয়াজুরির হোম চৌধুরীগণ নবাব মুর্শিদকুলি খানের সময় জলদস্যুতায় লিপ্ত ছিল। সুতরাং যেখানে খালিয়াজুরি সদরেই জলদস্যুর অবস্থান ছিল সেখানে জলদস্যুদের নৌযোগে চলাচলের গতিবিধি লক্ষ্য করার উদ্দেশ্যে ইমারত নির্মাণের জনশ্রুতি আমাকে ভাবনা ফেলে দেয়।
খালিয়াজুরির প্রাচীন ইমরাত সম্পর্কে আমার অনুসন্ধনে দেখা গেছে- স্থানীয় ভাবে এই পুরাকীর্তি বা ইমারত ‘মঠ’ নামে পরিচিত থাকলেও কেহ কেহ এটিকে ওয়াচ টাওয়ার হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে কাজ করি বিধায়, বিশাল জলরাশিপুর্ণ একটি জনপদে জলদস্যুদের নৌযোগে চলাচলের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য ইমারত বা ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণের বিষয়টি মনে কৌতুহল সৃষ্টি হয়েছিল বিধায় এটি বাস্তবে দেখার জন্য খালিয়াজুরি গিয়েছিলাম ২০১৬ সাল। তখন পরিত্যক্ত অবস্থায় অযত্নে অবহেলায় পরে থাকা এই ইমারত দেখে আমার কাছে মনে হয়েছিল এটি একটি সমাধিসৌধ বা মঠ। ব্রিটিশ আমলের ইট আর চুন সুরকির গাঁথুনি দিয়ে অনুমান পাঁচশত বর্গলিংক ভূমিতে নির্মিত চারকোনা বিশিষ্ট দেবে যাওয়া এই ইমারতের বর্তমান উচ্চতা অনুমান ১২/১৩ ফুট। এর এক পাশে মাত্র একটি খিলানো দরজা আছে। মঠের ভেঙ্গে যাওয়া চুঁড়া ক্রমশ সরু হয়ে উপরের দিকে উঠেছে। এ ধরণের ইমারত- সম্ভ্রান্ত, অভিজাত, মর্যাদাশালী, কুলীন, ধনী কোন হিন্দু ব্যক্তি মারা গেলে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়ে থাকে। এমন স্থাপনাগুলো এলাকাবিশেষ মঠ, মুর্তিশিলা ইত্যাদি নামে পরিচিত। এগুলো কেন্দ্র করে মৃতব্যক্তির বংশধরগণ নির্দিষ্ট সময়ে বাৎসরিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। আবার, কোনকোন এলাকায় এগুলো মন্দির হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। স্থানীয় ইতিহাসের প্রতি দূর্বলতা থেকেই এটি সম্পর্কে ব্যাপক অনুসন্ধান করতে থাকি। এক্ষেত্রে আমাকে আন্তরিক ভাবে সহযোগিতা করেছিলেন খালিয়াজুরি এলজিইডির তৎকালিন উপ-সহকারি প্রকৌশলী দুরুদ ভাই, প্রাক্তন উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা আমিনুল ভাই, ইউএনও অফিসের প্রাক্তন নৌযান চালক কালাম ভাই এবং দলিল লেখক সিরাজুল ইসলাম ফকির ভাই।
লোকমুখে জানাগেছে খালিয়াজুরি এলাকায় সিএস জরিপ হয়েছিল ১৯১০-১৯১৭ সালের মধ্যে। মঠ আকৃতির এই ইমারত নিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমার সংগ্রহে আসে ঐ ইমারতের একটি সিএস পর্চা। সেখানে যে বিবরণ লেখা আছে তা হচ্ছে- পরগণা খালিয়াজুরি, তৌজি নং ৭৪, মৌজা খালিয়াজুরি, উপরিস্থ স্বত্ব জমিদারি খালিয়াজুরী, বিবরণ ও দখলকার- উপরিস্থ স্বত্ব ক্রমিক নং ১০৩, ৩, ৩৭৬, ৫৩০, ৫২৯, ৪৫২, ৫৪৪, ৫৪৮, ৫৪৯, ৪, ১০৪, বিবরণ ও দখলকার- জমিদারি খালিয়াজুরী, হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী, দীনেশচন্দ্র রায় চৌধুরী, ওয়াজেদ আলী খান পন্নী, হায়দর আলী খান পন্নী, মুজাফর আল মুছাভি গং, ছেলামত খা গং, নেজামন্নেছা চৌধুরানীগং, তালুক রাজচন্দ্র চৌধুরী, দং শরৎচন্দ্র চৌধুরীগং, অত্রবস্বত্বের ক্রমিক নং ৭৭৯, বিবরণ ও দখলকার লাখেরাজ দীন নাথ চৌধুরী, দং রজনী নাথ চৌধুরী, বিপিন চন্দ্র চৌধুরী, সতীশ চন্দ্র চৌধুরী, পিতা দীন নাথ চৌধুরী, দখলকারের শ্রেণী চিরস্থায়ী মধ্যস্বত্বাধিকারী, খতিয়ানে মোট দাগ ১৭টি তন্মধ্যে দাগ নং ১১০১ বাড়ি, দাগ নং ১২২৬ পুকুর, দাগ নং ১২৮৬ বাড়ি, দাগ নং ১১০১, ১৪৩৭ পুকুর, দাগ নং ২৭৫৩ মঠবাড়ি, দাগ নং ৩০৩০, ৩৫৩৪ পুকুর পাড়। খতিয়ানে মোট জমির পরিমাণ ২৯ একর ৯৪ শতক, তন্মধ্যে প্রজাবিলি জমির পরিমাণ ৮ একর ৫৪ শতক, আপন দখলীয় জমির পরিমাণ ২১ একর ৪০ শতক। অত্র স্বত্বের প্রজাবিলি জমির বিবরণ নম্বর ৭৮৫, বিবরণ ও দখলকার (নীচস্থ স্বত্ব) জোত দং অভয়াচরণ মোদক গং। সিএস পর্চা থেকে যে বিষয়টি লক্ষনিয় তা হচ্ছে দাগ নং ২৭৫৩ মঠবাড়ি। যেহেতু সরকারি নথিপত্রে মঠ শব্দটি উল্লেখ আছে সেহেতু প্রচীন এই ইমারত ওয়াচ টাওয়ার কিংবা মন্দির বলার সুযোগ নেই বরং এটি খালিয়াজুরির কোনো এক অভিজাত, মর্যাদাশালী, ধনী হিন্দু ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত মঠ বা মুর্তিশিলা। সঙ্গত কারণে সিএস জরিপের সময় ভূমির শ্রেণী লেখা হয়েছে মঠবাড়ি।
উল্লেখ থাকা আবশ্যক এই মঠ যে ভূমিতে অবস্থিত সেই ভূমি ব্রিটিশ আমলে অন্যান্য জমিদারদের সাথে খালিয়াজুরির রাজচন্দ্র চৌধুরীর নামে উপরিস্থ স্বত্বের তালুক বন্দোবস্ত ছিল। যে উপরিস্থ স্বত্বের দখলকার ছিলেন শরৎচন্দ্র চৌধুরীগং। উল্লেখিত শরৎচন্দ্র চৌধুরীর দুই সন্তান সুধাংশু কুমার চৌধুরী, সুধির কুমার চৌধুরী (১৮৯৭-১৯৮৩)। উল্লেখিত সুধির কুমার চৌধুরীর কাব্যগুণে আকৃষ্ট হয়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক রামনন্দ চট্টোপাধ্যয় সুধির কুমার চৌধুরীকে কলকাতা ডেকে নেন। অতঃপর সুধির কুমার চৌধুরীকে ১৯২১ সালে প্রবাসী পত্রিকার সহকারি সম্পাদক নিযুক্ত করেন। পরবর্তীতে রামনন্দ চট্টোপাধ্যয়ের মেয়ে সীতাদেবীকে বিয়ে করেন উক্ত সুধির কুমার চৌধুরী। ভারতীয় গণমাধ্যম পেজফোর নামক অনলাইন পোর্টালে ২০২৩ সালের ১০ মার্চ প্রকাশিত বারিদবরণ ঘোষ এর ‘সীতাদেবী’ শিরনামে লেখা থেকে জানাযায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন। সুধির কুমার চৌধুরী এবং তাঁর স্ত্রী সীতাদেবী দুজনেই রবীন্দ্র যুগে কথা সাহিত্যে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তারা কলকাতা স্থায়িভাবে বসবাস করায় বংশধর কেউ খালিয়াজুরি ফিরেননি। উল্লেখিত রাজচন্দ্র চৌধুরী তালুকটি বেশ বড় ছিল। এই তালুকের পাশাপাশি খালিয়াজুরি পরগণার বিভিন্ন মৌজায় রাজচন্দ্র চৌধুরীর নামে জোত, লাখেরাজ, তালুক, সিকিমি তালুক ইত্যাদি ছিল। লোকমুখে জানাযায়, এই রাজচন্দ্র চৌধুরী খালিয়াজুরির সুধির কুমার চৌধুরীর পূর্বপুরুষ। যেহেতু এই পরিবারটি তৎকালীন সময় খালিয়াজুরি মৌজার অভিজাত, মর্যাদাশীল, ধনী পরিবার ছিল এবং তারা ছিলেন মঠ সংশ্লিষ্ট ভূমির উপরিস্থ স্বত্বের মালিকদের একজন ও খালিয়াজুরি মৌজার বড়হাটির স্থায়ি বাসিন্দা সেহেতু এই মঠ বা সমাধিসৌধ তাঁদের অর্থাৎ সুধির কুমার চৌধুরীর পূর্বপুরুষ কারো হওয়াটা অবান্তর নয়।
লিখেছেন : ফারুকুর রহমান চৌধুরী, গীতিকার, বাংলাদেশ বেতার এবং বহুমাত্রিক লেখক।