২৬শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিকাল ৪:৫৪
২৬শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিকাল ৪:৫৪

দাওয়াত সম্প্রসারণ:দাওয়াতি ময়দান ও দাওয়াতি টীম — আবু নাঈম মু শহীদুল্লাহ্

Share Option;

بالتقوى.
كل المسلم على المسلم حرام، دمه وماله وعرضه.
ألا هل بلغت؟ اللهم فاشهد.

আমি তোমাদের মাঝে এমন কিছু রেখে যাচ্ছি, যা আঁকড়ে ধরলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না—তা হলো: আল্লাহর কিতাব (কুরআন) ও আমার সুন্নাহ।
যারা এখানে উপস্থিত, তারা যেন অনুপস্থিতদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেয়। অনেক সময় যিনি শোনেননি, তিনি শ্রোতার চেয়েও ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেন।
হে মানুষ! সকলেই আদমের সন্তান। একমাত্র তাকওয়া ছাড়া কারও ওপর কারও শ্রেষ্ঠতা নেই—আরবের ওপর অনারবের, সাদার ওপর কালোর কোনো শ্রেষ্ঠতা নেই।
মুসলমান মুসলমানের ভাই; তার রক্ত, সম্পদ, ও সম্মান একে অপরের ওপর হারাম।
এরপর রাসুলুল্লাহ সাঃ সবাইকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেনঃ আমি কি তোমাদের কাছে আল্লাহর নির্দেশ পৌঁছে দিয়েছি?”
লোকেরা বলল: “জি হে আল্লাহর রাসূল।
তিনি বললেন: “হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক।

দাওয়াত সম্প্রসারণ
আল্লাহর রাব্বুল আলামিন তার দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। বিদায় হজ্জের দিন আয়াত নাযিল করে বলেছেন :
اَلْیَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِیْنَكُمْ وَ اَتْمَمْتُ عَلَیْكُمْ نِعْمَتِیْ وَ رَضِیْتُ لَكُمُ الْاِسْلَامَ دِیْنًا١ؕ فَمَنِ اضْطُرَّ فِیْ مَخْمَصَةٍ غَیْرَ مُتَجَانِفٍ لِّاِثْمٍ١ۙ فَاِنَّ اللّٰهَ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ
আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি, আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি সম্পূর্ণ করেছি এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছি। কাজেই তোমাদের ওপর হালাল ও হারামের যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে তা মেনে চলো। (আল-মায়িদাহ, আয়াত: ৩)
এই পরিপূর্ণ দ্বীনের দাওয়াত অনুপস্থিত লোকদের নিকট পৌঁছে দেওয়ার মহান দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন –
فليبلغ الشاهد الغائب
উপস্থিত ১ লাখ ২৪ হাজার মতান্তরে ১ লাখ ২০ হাজার সাহাবী সকলে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশে ও অঞ্চলে গমন করেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে খিলাফত, যুদ্ধ, শিক্ষা ও দাওয়াহ কাজে ব্যাপৃত হন। কেউ সিরিয়া, কেউ ইরাক, কেউ মিশর, কেউ পারস্য, আবার কেউ ভারতবর্ষ পর্যন্ত পৌঁছান।

সে সময়ে পৃথিবীর প্রভাবশালী শক্তি ছিল –
(ক)রোমান সাম্রাজ্য (বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য) ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার এক বিশাল অংশজুড়ে বিস্তৃত এক খ্রিস্টান শক্তি। যারা ছিল সাংস্কৃতিক, সামরিক ও প্রশাসনিক দিক থেকে অত্যন্ত উন্নত।

(খ). পারস্য সাম্রাজ্য (সাসানিয়ান সাম্রাজ্য):জরথুস্ট্রবাদ
( অগ্নিমন্দির (Fire Temple)এর পুজা করতো,
জ্বলন্ত আগুনকে পবিত্রতার ও সত্যের প্রতীক মনে করতো)। এটা এক মজবুত ও প্রাচীন সভ্যতা।
পারসিকরা রোমানদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল এবং প্রায়শই যুদ্ধ চলত তাদের মধ্যে।
এই দুই সাম্রাজ্য ছাড়াও কিছু আঞ্চলিক শক্তিও ছিল,যারা নিজ নিজ অঞ্চলে প্রভাবশালী ছিল যেমন :

(গ).হবশা (আবিসিনিয়া/ইথিওপিয়া):
খ্রিস্টান রাজত্ব ছিল, যারা আরব উপদ্বীপে হাতিম ইবনে আব্দুল কাল্লাল এবং আবরাহার সময় প্রভাব বিস্তার করেছিল।

(ঘ)চীন সাম্রাজ্য (তাং রাজবংশের পূর্বাবস্থা):
ইসলাম প্রচারের সময় চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল, যদিও সরাসরি রাজনৈতিক প্রভাব কম ছিল।

(ঙ)ভারতীয় উপমহাদেশের রাজ্যগুলো:
ইসলামের প্রাথমিক পর্বে এরা বিশ্বরাজনীতিতে খুব বেশি প্রভাবশালী ছিল না। তবে বিভিন্ন হিন্দু ও বৌদ্ধ রাজবংশ (যেমন: গুপ্ত সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি রাজ্যগুলো) সক্রিয় ছিল।
পৃথিবীর প্রতিষ্ঠিত শক্তি ও সভ্যতাগুলোর উপর দ্বীনকে বিজয় করার স্বপ্ন নিয়ে সাহাবায়ে কেরাম মক্কা থেকে দাওয়াতি মিশন নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।
আদেশের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যে চমৎকার নিদর্শন
রাসুল (সাঃ) বলেছেনঃ بَلِّغُوْا عَنِّىْ وَلَوْاٰيَهً
তোমরা আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত হলেও পৌঁছাও (সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৪৬১)। দ্বীনের দাওয়াত সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বেরিয়ে পড়া সাহাবীগন শুয়ে আছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। প্রতিষ্ঠিত সম্রাজ্যগুলোর সম্রাট ও প্রভাবশালী মহলের দ্বারায় বৈষম্যের স্বীকার হওয়া সমাজের কিছু ইসলামকে নেয়ামত হিসাবে কবুল করেছেন। বেশীর ভাগ মানুষই বিরোধিতা করেছিলেন।

দাওয়াত সম্প্রসারণে কিছু করনীয় দিক : আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত মানুষের নিকট পৌঁছে দেওয়া মুমিনদের দায়িত্ব, হেদায়েতের দায়িত্ব আল্লাহর। দাওয়াতি কাজ বৃদ্ধি বা দাওয়াতি অন্ঞ্চল সম্প্রসারণের জন্য কিছু বিষয় লক্ষ রাখতে হয়।

১.সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা :
দাওয়াত সম্প্রসারণে পরিকল্পনা গ্রহণের গুরুত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দাওয়াত কার্যক্রম একটি সুশৃঙ্খল, লক্ষ্যনির্ধারিত এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। তাই
যে এলাকায় দাওয়াতি কাজ করার চিন্তা করছেন সেখানে
কার উদ্দেশ্যে যাবেন, কিভাবে, কখন এবং কোথায় সাক্ষাৎ করবেন তা ঠিক করা জরুরী। পরিকল্পিত দাওয়াতি কার্যক্রম শ্রোতার প্রয়োজন ও মনস্তত্ত্ব বুঝে উপস্থাপন করা যায়, ফলে তা বেশি কার্যকর হয়।

২.উপকরণ : দাওয়াতি কাজের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সাথে রাখা। সহজ ভাষায় ইসলাম বুঝা যায় এমন ইসলামি সাহিত্য, কুরআন ও হাদিস এর কিছু খন্ড বা বই সাথে থাকলে শ্রোতার মন মানসিকতা বুঝে পড়তে দেওয়া।
সম্ভব হলে কিছু উপহার সামগ্রী নিয়ে যাওয়া, পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে উপহার দেওয়া।

৩.সহযোগী : নতুন এলাকায় দাওয়াতি কাজে একা না গিয়ে সাথে প্রশিক্ষিত ও আন্তরিক কিছু সহযোগী থাকলে
ইসলামের দাওয়াত সহজে উপস্থাপন করা যায়। তাই দাওয়াতি কাজের জন্য যখনই কোন এলাকা পছন্দ করবেন। তখনই একটা সহযোগী টীম ঠিক করে নেওয়া।

৪.দ্বীনের দাঈদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে ধারনা রাখা এবং শিক্ষা গুলো কাজে লাগানো।
যাদের জীবনী মানুষের হৃদয়ে দাগকাটে যেমন :-
১. হজরত মুহাম্মদ (সা.) ৫৭০–৬৩২
২. হজরত আবু বকর (রাঃ) ৫৭৩–৬৩৪
৩. হজরত উমর (রাঃ) ৫৮৪–৬৪৪
৪. হজরত উসমান (রাঃ) ৫৭৬–৬৫৬
৫. হজরত আলী (রাঃ) ৬০০–৬৬১
৬. হাসান আল-বাসরি (রহঃ) ৬৪২–৭২৮
৭. ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) ৬৯৯–৭৬৭
৮. ইমাম মালিক (রহঃ) ৭১১–৭৯৫
৯. ইমাম শাফি’ঈ (রহঃ) ৭৬৭–৮২০
১০. ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) ৭৮০–৮৫৫
১১. ইমাম আল-গাজ্জালী (রহঃ) ১০৫৮–১১১১
১২. আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) ১০৭৭–১১৬৬
১৩. ইবনে তাইমিয়্যা (রহঃ) ১২৬৩–১৩২৮
১৪. ইবনে কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ (রহঃ)১২৯২–১৩৫০
১৫. শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) ১৭০৩–১৭৬২
১৬. আহমদ শরীফ সনুসী (রহঃ) ১৭৮৭–১৮৫৯

লিবিয়ায় দাওয়াত ও উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন।
১৭. সাইয়্যেদ জামালুদ্দীন আফগানী ১৮৩৮–১৮৯৭
১৮. শেখ উবাইদুল্লাহ সিন্ধী ১৮৭২–১৯৪৪
ভারতীয় উপমহাদেশে দাওয়াতি ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন।
১৯. মওলানা আবুল কালাম আজাদ ১৮৮৮–১৯৫৮
ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে দাওয়াত ও শিক্ষার প্রসার ঘটান; ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
২০. আবুল আ’লা মওদূদী (রহঃ) ১৯০৩–১৯৭৯
আধুনিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইসলামের দাওয়াত৷

দাওয়াতি ময়দান ও দাওয়াতি টীম :
আল্লাহর একত্ববাদের দিকে মানুষকে আহ্বান করার কাজ শুরু করতে হয় নিজের পরিবার ও বাড়ি থেকে। ধীরে ধীরে যখন এই দাওয়াতের পরিসর বৃদ্ধি পায়, তখন একা একা কাজ চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাই আপনি যেই ময়দানে, যেই দেশে দাওয়াতি কাজ করুন না কেন—তা মুসলিম দেশ হোক বা অমুসলিম—দাওয়াতকে স্বল্প সময়ে বেশি মানুষের কাছে সুন্দর ও কার্যকরভাবে পৌঁছে দিতে একটি সংগঠিত টীমের প্রয়োজন হয়। একটি দক্ষ টীম দাওয়াতি কাজকে গতিশীল ও বিস্তৃত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

যাদের নিয়ে টীম তৈরী করবেন:

১.যাদের মধ্যে আন্তরিকতা ও খুলুসিয়াত রয়েছে।
২.যারা দায়িত্ববান, বিশ্বস্ত ও সময় সেক্রিফাইস করার মানসিকতা রাখেন।
৩.যাদের মধ্যে দাওয়াতের আদব, কৌশল, মনস্তত্ত্ব, কুরআন-হাদীসের জ্ঞান এবং সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার যোগ্যতা আছে।
৫.যারা আনুগত্য,শৃঙ্খলা ও ভ্রাতৃত্বপূর্ন পরিবেশ বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর।
৬.যাদের আমল ও মোয়ামেলাত সুন্দর। এবং
৭.যারা নিজেদের টীমকে পরিচ্ছন্ন রাখতে পরিবেশ ঠিক রেখে গঠন মুলক সমালোচনা কুন্ঠাবোধ করেন না।

দাওয়াতি টীম গঠন করতে একেকজনকে একেকটি দায়িত্ব দিলে সহজে ভাল ফলাফল পাওয়ায় যাবে-যেমন:

দাওয়াতি বক্তা বা আলোচক
নির্দিষ্ট বিষয়ে লেখা ও কন্টেন্ট প্রস্তুত কারী
প্রোগ্রাম ডিজাইন ও প্রচারনায় সহায়তাকারী
ফলো-আপ ও রিপোর্ট রক্ষাকারী
‌>চারিদিকের পরিবেশ সম্পর্কে নজর রাখার জন্যও দায়িত্ব
বিনদেশে হলে ভাষাগত দক্ষ ব্যক্তিকে বক্তা হিসেবে কাজে লাগানো।

ব্যক্তিগত উদ্যোগে দাওয়াতি কাজ সমাজ পরিবর্তনে যতটুকু ফল ভয়ে আনে। তার চাইতে হাজার গুন বেশী ফল পাওয়া যায় একটি সুপরিকল্পিত, আন্তরিক এবং আল্লাহভীরু দাওয়াতি টীমের মাধ্যমে।

চলবে——
বই – দাঈ ও সংগঠক- লেখক- আবু নাঈম মু শহীদুল্লাহ্


Share Option;

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *