আধুনিক সভ্যতায় শক্তিশালী অর্থনীতি,উন্নত মানের চিকিৎসা সেবা,সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য,বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দিক বিবেচায় ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্পেন এবং পর্তুগাল। তবে ইতিহাস পর্যালোচনায় মুসলিম শাসনামলে স্পেন ও পর্তুগাল ছিল তৎকালীন ইউরোপের সেরা ও শীর্ষে। যার কিছু নিদর্শন আমরা এখনো দেখতে পাই। আমি আপনাদের জন্য মুসলিম শাসনামলের কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা চিত্র সহ উপস্থাপন করছি।
আলহাম্ব্রা প্রাসাদ (Granada)-ঃ
আলহাম্ব্রা প্রাসাদ (Alhambra) স্পেনের গ্রানাডা (Granada) শহরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক ও স্থাপত্যিক নিদর্শন। এটি মূলত একটি রাজপ্রাসাদ ও দুর্গ।
১৩শ শতকের মাঝামাঝি, নাসরিদ সুলতান মুহাম্মদ ইবন আল-আহমারের শাসনামলে নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
প্রথমে একটি দুর্গ হিসেবে শুরু হলেও ধীরে ধীরে রাজপ্রাসাদ, মসজিদ, উদ্যান ও প্রশাসনিক ভবনের সমন্বয়ে একটি চমৎকার স্থাপত্যরূপ নেয়।
এটি নির্মাণে ব্যবহৃত হয় ইট, কাঠ, প্লাস্টার এবং মার্বেল। দেয়ালে জটিল আরবি লেখা, জ্যামিতিক নকশা ও মোজাইকের অসাধারণ কাজ, জল ব্যবস্থাপনায় চমৎকার কৌশল প্রয়োগ—ঝরনা, ফোয়ারা ও খালের মাধ্যমে ঠাণ্ডা পরিবেশ সৃষ্টি। সবমিলিয়ে এটি এক অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীতে পরিণত হয়।
আলহাম্ব্রা শব্দটি আরবি “আল-হামরা” থেকে এসেছে, যার অর্থ “লাল প্রাসাদ” — সম্ভবত এর লালচে ইট-পাথরের কারণে এমন নাম।
প্রাসাদটি মুসলিম, খ্রিস্টান ও রেনেসাঁ যুগের স্থাপত্যের সংমিশ্রণ এবং এটি ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃত।
এটি আজও স্পেনের ইসলামিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ স্মারক এবং বিশ্বজুড়ে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
কর্ডোভা মসজিদ (মসজিদ-ক্যাথেড্রাল অব কর্ডোবা)–ঃ স্পেনের আন্দালুসিয়া অঞ্চলের কর্ডোবা শহরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা হচ্ছে কর্ডোভা মসজিদ। বিশ্বজুড়ে যার পরিচিত (Mezquita-Catedral de Córdoba) হিসাবে।
৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে উমাইয়া খলিফা আবদুর রহমান নির্মাণ কাজ শুরু করেন। পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে মসজিদটি বিভিন্ন উমাইয়া শাসকদের অধীনে সম্প্রসারিত হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আল-হাকাম II-এর সময়কালে নির্মিত মিহরাব ও মাকসুরা। ১২৩৬ সালে খ্রিষ্টান রাজা ফের্দিনান্দ III কর্ডোবা দখল করার পর মসজিদটি একটি ক্যাথেড্রালে রূপান্তরিত হয়। তবে মূল স্থাপত্যের অনেকাংশ অক্ষত রাখা হয়। ১৬শ শতকে ক্যাথেড্রালের কেন্দ্রে একটি রেনেসাঁ শৈলীর নেভ নির্মিত হয়, যা স্থাপনাটিকে আরও বৈচিত্র্যময় করে তোলে।
মসজিদটি ১৯৮৪ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা লাভ করে। এটি কর্ডোবার ঐতিহাসিক কেন্দ্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং স্পেনের অন্যতম প্রধান পর্যটন আকর্ষণ।
মদিনাত আল-জাহরা (Córdoba)-ঃ
প্রাচীন ইসলামিক রাজকীয় নগরীর নাম হলো মদিনাত আল-জাহরা(Medinat al-Zahra) যা স্পেনের Córdoba শহরের নিকটে অবস্থিত। উমাইয়া খলিফা তৃতীয়
আবদুর রহমান ১০ম শতাব্দীতে নির্মাণ করেছিলেন। যার অর্থ হলো উজ্জ্বল নগরী
অভ্যান্তরীন কোন্দল ও গৃহ যুদ্ধের সময়ে
(১০০৯-১০১০) অনেকাংশ ধ্বংস হয়ে যায়।
বর্তমানে এটি একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃত। মদিনাত আল-জাহরা ইসলামিক স্পেনের স্থাপত্য, নগর পরিকল্পনা ও সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল সাক্ষ্য বহন করে।
আলকাসার অব সেভিলঃ-
স্পেনের আন্দালুসিয়া অঞ্চলের সেভিল শহরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক রাজপ্রাসাদের নাম আলকাসার অব সেভিল (Alcázar of Seville) যা ইউরোপের সবচেয়ে প্রাচীন ব্যবহারযোগ্য রাজপ্রাসাদগুলোর একটি এবং ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের অন্তর্ভুক্ত।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
আলকাসারের সূচনা ইসলামি শাসনামলে, যখন সেভিল মুসলিমদের অধীনে ছিল। ৯ম শতকে মূরিশ আমিররা এখানে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। ১১শ শতকে এটি ছিল আবাদ রাজবংশের (Abbadid dynasty) রাজধানী।
১২৪৮ সালে খ্রিস্টান রাজা ফার্দিনান্দ III সেভিল দখল করেন। এরপর মুসলিম স্থাপত্যের উপরে খ্রিস্টীয় রাজারা নিজেদের রূপ যোগ করতে থাকেন।
১৩শ থেকে ১৫শ শতাব্দীতে আলকাসারে স্প্যানিশ-ইসলামি স্থাপত্য শৈলী, যাকে Mudéjar বলা হয়, এর সেরা নিদর্শন দেখা যায়। পিটার I (Pedro I) “দ্য ক্রুয়েল” ১৪শ শতকে প্রাসাদের পুনর্নির্মাণ করেন মুসলিম কারিগরদের দিয়ে।
পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে রেনেসাঁ ও বারোক শৈলীতে আরও কিছু অংশ সংযোজন হয়। আজও স্প্যানিশ রাজপরিবার সেভিল সফরের সময় এখানে অবস্থান করে থাকেন ।এটি এক বিস্ময়কর বাগান,যার অলঙ্কৃত খিলান, ফোয়ারা এবং কারুকার্যময় দেয়াল ইসলামী ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির মিলনের এক অসাধারণ নিদর্শন বহন করে আছে।
আলকাসার অব জেরেজ ডে লা ফ্রন্টেরা (Jerez de la Frontera)-ঃ১১শ শতাব্দীতে মুরিশ শাসনামলে নির্মিত একটি ঐতিহাসিক দুর্গ ও প্রাসাদ, যা স্পেনের আন্দালুসিয়া অঞ্চলের জেরেজ ডে লা ফ্রন্টেরা শহরে অবস্থিত। এটি আন্দালুসিয়ার অন্যতম প্রাচীন ও সংরক্ষিত মুরিশ দুর্গ।
মসজিদ, রাজপ্রাসাদ, প্রতিরক্ষা টাওয়ার,বাগান ও হ্যামাম নিয়ে চমৎকার এ দূর্গটি খ্রিস্টান রাজারা তাদের ব্যবহারের উপযোগী করে সংস্কার করে নিয়েছে ।এটি আলমোহাদ শাসনামলের একটি নিদর্শন।
আলকাসাবা অব মালাগা (Alcazaba of Málaga)-ঃ স্পেনের মালাগা শহরে অবস্থিত একটি প্রাচীন মোরিশ দুর্গের নাম হচ্ছে আলকাসাবা। স্পেনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ইসলামিক স্থাপনা।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
১১শ শতাব্দি হামুদি রাজবংশ মালাগা শাসনকালীন সময়ে আলকাসাবার নির্মাণ কাজ শুরু করে। এটি সামরিক দুর্গ হিসেবে নির্মিত যা শহরকে বাইরের আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে। পাহাড়ের উপরে নির্মিত দূর্গটি শহর ও সমুদ্রের দিকে নজরদারির চমৎকার ব্যবস্থা রাখা৷ হয়েছে।
পরবর্তীকালে নাসরিদ রাজবংশ (গ্রানাডার সুলতানগন) এটি আরও মজবুত করে এবং কিছু অংশ পুনর্নির্মাণ করে।এর ভেতরে ছিল বাগান, ফোয়ারা, প্রাসাদ ও সেনাবাহিনী কোয়ার্টার।
১৪৮৭ সালে স্পেনের ক্যাথলিক রাজারা (Queen Isabella ও King Ferdinand) মালাগা দখল করে নেন।
আলকাসাবা তখন খ্রিষ্টানদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং কিছু সামরিক ব্যবহার অব্যাহত থাকে। আরবীয় ধাঁচের আর্চ, মোজাইক, এবং জলের ফোয়ারা। অভ্যন্তরীণ দুর্গপ্রাচীর এবং প্রবেশপথের গোলকধাঁধার মতো নকশা আক্রমণকারীদের বিভ্রান্ত করে দিতো। আলকাসাবা থেকে মালাগা শহরের দারুণ দৃশ্য দেখা যায়, এবং এটি স্পেনে ইসলামিক স্থাপত্যের অন্যতম সেরা উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত। বর্তমানে এটি জনপ্রিয় পর্যটন স্থান এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষিত।
আলকাসাবা অব আন্তেকেরা (Antequera) –: স্পেনের আন্দালুসিয়া আন্তেকেরা শহরে ১১শতকে নির্মিত আলকাসাবা অব আন্তেকেরা (Alcazaba of Antequera) দূর্গ। যা মুসলিম মুর শাসকগন
আন্তেকেরা শহরের উপর প্রভাব বিস্তার এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে তৈরী করেন।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
মুসলিম মুর (Muslim Moors) শাসকরা আলকাসাবা নির্মাণ করেন শহর রক্ষার ও খ্রিস্টান রাজ্যের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে।
দুর্গটি স্থাপন করা হয়েছে পাহাড়ের ওপর যাতে শহরটি সহজেই নজরদারি করা যায়। এটি সেভিল (Seville) এবং গ্রানাডার (Granada) মাঝখানে।
১৪শ শতকে খ্রিস্টানরা আন্তেকেরা পুনর্দখল করে (১৪১০ সালে)। পরে তারা আলকাসাবার কিছু অংশ পুনর্গঠন ও সম্প্রসারণ করে, যার মধ্যে রয়েছে একটি খ্রিস্টান গির্জা (Church of Santa María)।বর্তমানে এটি একটি পর্যটন আকর্ষণ এবং স্পেনের মধ্যযুগীয় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত।
আলজাফেরিয়া প্রাসাদ (Zaragoza) –:
স্পেনের সারাগোসা (Zaragoza) শহরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক ইসলামিক প্রাসাদের নাম আলজাফেরিয়া প্রাসাদ (Palacio de la Aljafería)।
এটি ১১শ শতকে তাঈফা আমলের মুসলিম শাসক আবু জাফার আল-মুকতাদির নির্মাণ করেন। এটি ছিল তার রাজকীয় বাসভবন ও শক্তিশালী দুর্গ।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
আল-মুকতাদির কর্তৃক নির্মিত প্রাসাদটির নাম ছিল “ক্যাসর আল-সুরুর” বা “আনন্দের প্রাসাদ”।
খ্রিস্টান রাজা আলফোনসো ১১১৮ সালে
দখল করে নেয়।১৪শ-১৫শ শতকে ক্যাথলিক মুকুটের অধীনে এটি গথিক ও রেনেসাঁ শৈলীতে পুনর্নির্মাণ ও সম্প্রসারণ করা হয়, বিশেষত ক্যাথলিক রাজা ফার্দিনান্দ ও ইসাবেল্লার সময়। পরবর্তীতে এটি সামরিক দুর্গ, জেলখানা এবং সেনা সদর দপ্তর হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
বর্তমানে এটি আরাগোন পার্লামেন্টের আসন এবং একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। আলজাফেরিয়া স্পেনে ইসলামী স্থাপত্যের অন্যতম চমৎকার নিদর্শন এবং এটি ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী আল-আন্দালুস আমলের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি।
জেনারালিফ প্রাসাদ (Granada) –
জেনারালিফ প্রাসাদ (Generalife) স্পেনের গ্রানাডা শহরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক ইসলামিক বাগান ও প্রাসাদ, যা আলহাম্ব্রা প্রাসাদ কমপ্লেক্সের অংশ। এটি নাসরিদ রাজবংশের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ হিসেবে নির্মিত হয়েছিল।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
১৩শ শতকে নাসরিদ সুলতান মুহাম্মদ II বা মুহাম্মদ III-এর শাসনামলে এটি নির্মিত হয়।
যা সুলতানদের গ্রীষ্মকালীন বাসভবন ও বিশ্রামের স্থান।আরবি শব্দ “جنة العريف” (Jannat al-‘Arīf) থেকে এসেছে, যার অর্থ “উচ্চস্থানের বাগান” বা “স্থপতির বাগান”।
এটি আন্দালুসীয় ইসলামিক স্থাপত্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অসাধারণ সংমিশ্রণ। প্রাসাদটি জলচক্র, জলাধার, গাছপালা এবং ছায়াময় পথ দিয়ে পরিপূর্ণ।গ্রানাডা ১৪৯২সালে খ্রিস্টানদের হাতে চলে গেলে জেনারালিফের কিছু অংশে ইউরোপীয় প্রভাব যুক্ত হয়, তবে মূল ইসলামিক গঠন অনেকাংশে সংরক্ষিত থাকে।
বর্তমানে: এটি একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান (UNESCO World Heritage Site) এবং গ্রানাডার অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণ।
গিরালদা মিনার (Seville)-:
গিরালদা মিনার (La Giralda) হলো স্পেনের সেভিয়া শহরের একটি ঐতিহাসিক ও স্থাপত্যিক নিদর্শন। এটি মূলত একটি মিনার।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
মুসলিম শাসন আমলে (almohad) ১১৮৪ সালে
গিরালদার নির্মাণ শুরু হয়। এটি মূলত সেভিয়ার প্রধান মসজিদের মিনার হিসেবে তৈরি হয়। মিনারটির স্থাপত্য মারোক্কোর মারাকেশের কাটুবিয়া মসজিদের অনুকরণে তৈরি।
১২৪৮ সালে খ্রিস্টানরা সেভিয়া দখল করে এবং মসজিদটিকে গির্জায় রূপান্তর করে। পরবর্তীতে মসজিদটি ধ্বংস করে সেখানে গথিক ঘরানার বিশাল সেভিয়া ক্যাথেড্রাল নির্মাণ করা হয় (১৪০০-এর দশকে)।
১৫৬৮ সালে মিনারের উপরে একটি রেনেসাঁ শৈলীতে নির্মিত ঘণ্টাধ্বনি টাওয়ার যোগ করা হয়। মিনারের শীর্ষে একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি (El Giraldillo) বসানো হয়, যা ‘বিশ্বাস’-এর প্রতীক এবং মিনারটির নাম ‘La Giralda’ সেখান থেকেই এসেছে।বর্তমানে গিরালদা মিনার ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এবং সেভিয়ার অন্যতম প্রতীক। এটি পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি স্থাপনা।
মসজিদ বাব আল-মার্দুম
(ক্রিস্তো দে লা লুজ মসজিদ Toledo) –
ক্রিস্তো দে লা লুজ মসজিদ (Cristo de la Luz Mosque) হলো স্পেনের টোলেডো শহরে অবস্থিত একটি ছোট কিন্তু ঐতিহাসিক স্থাপনা।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
মুরিশ শাসনামলে ৯৯৯ সালে নির্মিত হওয়া মসজিদ বাব আল-মার্দুম টোলেডোর শহরের প্রবেশদ্বারের একটি মসজিদ। এর নির্মাণে স্পষ্টভাবে দেখা যায় ইসলামিক আন্দালুসিয়ান ও মোজারাবিক শৈলীর মিশ্রণ। এটি ৯টি ছোট গম্বুজে বিভক্ত এবং অভ্যন্তরীণ কলাম ও খিলানগুলি ইসলামী জ্যামিতিক শিল্পের নিদর্শন।
১০৮৫ সালে আলফনসো VI টোলেডো দখল করেন। এরপর ১২ শতকের দিকে মসজিদটি একটি খ্রিস্টান চ্যাপেল হিসেবে রূপান্তরিত হয়, এবং নাম দেওয়া হয় “Cristo de la Luz” অর্থাৎ “আলোকের খ্রিস্ট”।বর্তমানে এটি একটি ছোট জাদুঘর ও পর্যটন কেন্দ্র। এটি স্পেনে বেঁচে থাকা সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ স্থাপনাগুলোর একটি।
মুন্দ্রাগন প্রাসাদ (Ronda) –
মুন্দ্রাগন প্রাসাদ (Palacio de Mondragón) হলো স্পেনের আন্দালুসিয়ার রোন্দা (Ronda) শহরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক প্রাসাদ। যা নির্মিত হয় ১৩শ শতকে মুরিশ (Muslim) শাসনামলে।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
রোন্দার মুসলিম আমির বা গভর্নরের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হত এই প্রসাদ। যার স্থাপত্যশৈলীতে আন্দালুসিয়ান ইসলামি শিল্প স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে।
১৪৮৫ সালে রোন্দা খ্রিস্টানদের হাতে চলে গেলে প্রাসাদটি খ্রিস্টান সম্ভ্রান্ত পরিবারদের দখলে যায়। বিশেষ করে ডন আলোনসো দে মন্ড্রাগন নামক এক অভিজাত ব্যক্তির নামে এটি পরিচিত হয়। রেনেসাঁ ও গথিক শৈলীতে পরবর্তীতে কিছু অংশ পুনর্গঠন করা হয়।
প্রাসাদে ইসলামি খিলান, মোজাইক ও জলবাহিত বাগান রয়েছে, জলের ঝর্ণা ও সুশোভিত উদ্যান, যা মুসলিম স্থাপত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
বর্তমানে এটি রোন্দার পৌর জাদুঘর (Museo Municipal de Ronda) হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে রোন্দা অঞ্চলের প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে নানা প্রদর্শনী রয়েছে।
কাস্তেলো দে আলমোদোভার দেল রিও (Almodóvar del Río) –
স্পেনের আন্দালুসিয়া অঞ্চলের কোর্দোবা প্রদেশে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক দুর্গের নাম কাস্তেলো দে আলমোদোভার দেল রিও (Castillo de Almodóvar del Río)। এটি গুয়াদালকিবির (Guadalquivir) নদীর তীরের ছোট শহর Almodóvar del Río-তে অবস্থিত।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
এই স্থানে প্রাথমিকভাবে রোমান ও পরে ভিসিগথদের সময় কিছু প্রতিরক্ষামূলক কাঠামো ছিল বলে ধারণা করা হয়।
বর্তমান দুর্গটির মূল গঠন ৮ম শতকে মুসলিম মুর (Muslim Moors) শাসকদের দ্বারা তৈরি করা হয়। তারা এটি কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে শক্ত দুর্গে পরিণত করে।
১৩শ শতাব্দীতে খ্রিস্টান রাজারা পুনর্দখল এবং
ব্যাপক সংস্কার করে। এটি রাজকীয় কারাগার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছিল।১৯০১–১৯৩৬ সাল ডন রাফায়েল ডেসমাইসিয়েরস (Rafael Desmaissières), Count of Torralva, দুর্গটির ধ্বংসাবশেষ কিনে এটি পুনরুদ্ধার করেন এবং আধুনিক রূপে সংস্কার করেন।বর্তমানে এটি একটি পর্যটন আকর্ষণ কেন্দ্র।
কাস্তেলো দে সান্তা বারবারা (Alicante) – স্পেনের আলিকান্তে শহরের একটি অন্যতম বৃহৎ ও প্রাচীন দুর্গ। এটি ভূমধ্যসাগরের উপকূলের পাশে বেনাকান্তিল (Benacantil) পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত, যেখানে থেকে পুরো শহর ও সমুদ্রের অসাধারণ দৃশ্য দেখা যায়।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
প্রাচীন সময়: এই স্থানে কার্থাজিনীয় ও রোমানদের বসতি ছিল বলে ধারণা করা হয়, তবে দুর্গের প্রকৃত নির্মাণ শুরু হয় পরে।
৯ম শতাব্দী (মুসলিম শাসন): ৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে, মুসলিম মুর শাসকেরা দুর্গ নির্মাণ করেন, যেটি তখন আন্দালুসিয়া অঞ্চলের প্রতিরক্ষা কাঠামোর অংশ ছিল।
১২৪৮ খ্রিস্টাব্দ: ক্যাস্টিলের রাজা আলফোনসো X “El Sabio” দুর্গটি দখল করেন খ্রিস্টান পুনর্দখলের সময়। দুর্গটি ৪ঠা ডিসেম্বর (সান্তা বারবারার দিবস) দখল হয়েছিল, তাই নামকরণ হয় “Castillo de Santa Bárbara”।
১৬শ–১৮শ শতাব্দী: দুর্গটি বারবারি জলদস্যু ও অন্যান্য আক্রমণকারীদের থেকে শহর রক্ষায় ব্যবহৃত হয়। এটি বিভিন্ন সময়ে সামরিক ও রাজনৈতিক কারাগার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছিল।
১৯৬৩ সাল: দুর্গটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয় এবং একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে।বর্তমানে এটি একটি জনপ্রিয় ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান, যেখানে জাদুঘর, প্রদর্শনী এবং শহরের দর্শনীয় প্যানোরামিক ভিউ উপভোগ করা যায়।
মুরিশ বাথস অব জেন (Jaén) –
স্পেনের আন্দালুসিয়া অঞ্চলের জেন (Jaén) শহরে অবস্থিত, ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ ও সুসংরক্ষিত গণস্নানাগার (পাবলিক টয়লেট)
মুসলিম শাসন আমলের তৈরী।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
ইসলামি সংস্কৃতিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায়, এই ধরনের বাথ বা হাম্মাম তৈরী ছিল প্রশংসনীয়
সামাজিক কাজ। ১১শ শতকে, জেন শাসন করতো মুসলিম শাসক জিরি রাজবংশ (Zirí dynasty) পরবর্তীতে নাসরিদ রাজবংশ (Nasrid dynasty) এর রাজা। মুরিশ বাথস অব জেন (Jaén) এ৷ মানুষ বিশ্রাম, পরিচ্ছন্নতা এবং সামাজিক আড্ডার মেতে থাকতো।
১৩০০ শতকে খ্রিস্টানরা জেন পুনর্দখল করে এবং এই হাম্মামকে অন্যান্য কাজে রূপান্তর করে, যেমনঃ তেল কারখানা ও বসতি।
বর্তমান সময়ে এটি Centro Cultural Baños Árabes নামে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের অংশ।
চলবে —