২২শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
রাত ১০:৫৪
২২শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
রাত ১০:৫৪

প্রসঙ্গ:খালিয়াজুরি পরগণার ধানকোড়া এস্টেট-ফারুকুর রহমান চৌধুরী।

Share Option;

বাংলাদেশের ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোণা জেলার হাওর বেষ্টিত উপজেলা খালিয়াজুরি। এই উপজেলার আয়তন ২৯৭.৬৪ বর্গকিলোমিটার। এর ষোলআনা অংশ ব্রিটিশ আমলে খালিয়াজুরি পরগণার অর্ন্তভূক্ত ছিল। তৎকালীন কেন্দুয়া এবং কিশোরগঞ্জ সিএস থানার মোট ৮২ টি মৌজা মিলে খালিয়াজুরি পরগণা গঠিত ছিল। এই পরগণার আয়তন ছিল ৮২ হাজার ০৭৭ একর বা ১৩০ বর্গমাইল। ব্রিটিশ পূর্ব সময়ে খালিয়াজুরি পরগণা আয়তনে প্রায় দ্বিগুণ ছিল। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত মোঃ হাফিজুর রহমান ভূইঞার বই ময়মনসিংহের জমিদারি ও ভূমিস্বত্ব ১৮৫৪-১৯৬০ এর ১০৯ পৃষ্টায় লেখা হয়েছে- খালিয়াজুরি পরগণার মূল ভূভাগ খালিয়াজুরি থানার অর্ন্তভূক্ত হয়। কিছু অংশ মদন, কেন্দুয়া ও কিশোরগঞ্জের ইটনা থানার অর্ন্তভূক্ত হয়। কেদারনাথ মজুমদার প্রণীত মৈমনসিংহের ইতিহাস ও মৈমনসিংহের বিবরণ গ্রন্থ হতে জানাযায়- ব্রিটিশ প্রারম্ভকালে ৫ জন হিন্দু এবং ৪ জন মুসলমান জমিদার এই পরগণার মালিক ছিলেন। ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দ বা ১২০৪ বঙ্গাব্দে এই নয় জমিদারগণ ঋণগ্রস্ত হয়ে পুরান ঢাকার আর্মানীটুলার বাসিন্দা আর্মেনিয়া দেশের নাগরিক খাজে ওয়ালিসের নিকট আট আনা হিস্যা বিক্রি করেন, বাকী আট আনা হিস্যা তাঁর নিকট নয় বছর মেয়াদে ইজারা দেন। কিছুদিন পর খাজে ওয়ালিস ইজারা মহালের তর্কে মালিকগণের নামে ক্ষতিপুরণের নালিশ করেন। ওয়ালীসের দাবির ডিক্রির জন্য মহাল ক্রোক হয়। মলিকগণ অনন্যোপায় হয়ে ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দ বা ১২১৫ সনে ইজারাকৃত আট আনা হিস্যা মানিকগঞ্জের ধানকোড়ার রামকৃষ্ণ রায় এবং রাজকৃষ্ণ রায়ের নিকট বিক্রি করেন। ওয়ালিসের মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকার দুই মেয়ের মধ্যে এক মেয়ের হিস্যা ক্রয় করেন ধাকোড়ার জমিদার। এভাকে ধানকোড়ার জমিদার খালিয়াজুরি পরগণার বারো আনা হিস্যারর মালিকানা লাভ করেন। তন্মধ্যে ৪ গন্ডা অংশ হিস্যা নেত্রকোণা জেলার মদন উপজেলার কদমশ্রী গ্রামের আকতরজমা খার মালিকানায় চলে যায়। অর্থাৎ খালিয়াজুরি পরগণার ষোল আনা জমিদারির মধ্যে ১১ আনা ১৫ গন্ডা ২ কড়া ১ ক্রান্তি ১০ তিল হিস্যার থেকে যায় মানিকগঞ্জের ধানকোড়া জমিদারের মালিকানায়। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৭ সালের মধ্যে জমিদারি অধিগ্রহণ সময় পর্যন্ত এই হিস্যা তাদের হাতেই ছিল। জমিদারি অধিগ্রহণ রেজিস্টার অনুযায়ি খালিয়াজুরি পরগণায় ধানকোড়া এস্টেট ২ এর জমিদার ছিলেন দ্বিজেশ চন্দ্র রায় চৌধুরী। মোঃ হাফিজুর রহমান ভূঁঞা প্রণীত ময়মনসিংহের জমিদারি ও ভূমিস্বত্ব ১৮৫৪-১৯৬০ গ্রন্থের ২১১ পৃষ্ঠা হতে জানাযায়, ধানকোড়া এস্টেটের রাজস্ব দাবি চিল ১,২৯,৯৯৭ টাকা। এর তিন চতুর্থাংশ ছিল ময়মনসিংহের ভূমির রাজস্ব। এই এস্টেটের ৬টি কাচারি ছিল। সদর ময়মনসিংহ কাচারির দায়িত্বে ছিলেন একজন তত্ত্বাবধায়ক এবং বাকি কাছারিগুলোর দায়িত্বে ছিলেন ১ জন করে নায়েব। মোট কর্মাচারীদের মধ্যে ছিল ১ জন তত্ত্বাবধায়ক, ৬ জন নায়েব, ৬ জন তহশিলদার, ২৯ জন মুহুরি, ১ জন দপ্তরি, ৬ জন মুক্তার, ১ জন মৃধা, ৩ জন জমাদার, ৫১ জন পিয়ন, ১৭ জন কুলি, ১ জন মেথর। প্রায় অর্ধেকের বেশি কর্মচারী ছিল নিম্নপদস্ত। প্রয়োজনের সময় তাদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। শুধু খালিয়াজুরি পরগণা নয়, জোয়ানশাহী, মায়মনসিংহ প্রভৃতি পরগণায়ও ধানকোড়া জমিদারির সম্পত্তি ছিল বলে জানাযায়।

ধানকোড়া গ্রামে একাধিক লোকের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারলাম ধানকোড়ার জমিদার দীনেশ চন্দ্র রায় চৌধুরী পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের নর্থব্রুক হল রোডে স্থায়ি ভাবে বসবাস করতেন। এ তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে বাংলা ট্রিবিউ পত্রিকায় ২০১৯ সালের ০৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে। সেখানে লেখা হয়েছে- জমিদার বাড়িটি সূত্রাপুর থানার পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের নর্থব্রুক হল রোডে ৩৮ নম্বর হোল্ডিংধারী। এ বাড়িতে একসময়ে বসবাস করতেন মানিকগঞ্জের ধানকোড়া এস্টেটের জমিদার দ্বিজেশ চন্দ্র রায় চৌধুরী। একাত্তরে যুদ্ধের আগেই তিনি সপরিবারে ভারতে চলে যান। সূত্রাপুর মৌজার এস.এ ৪৩৪০ নম্বর খতিয়ানে ৬৯৯৩ ও ৬৯৯৪ নম্বর দাগের জমি দ্বিজেশ চন্দ্র রায়ের বাবা দ্বিনেশ চন্দ্র রায়, ৩৮ নর্থব্রুক হল রোডের নামে এস.এ রেজিস্ট্রি হয়। এই জমিটি অর্পিত সম্পত্তি তালিকার ৬৫০ নম্বর ক্রমিকে এবং ভিপি (ভ্যাস্টেড প্রপার্টি) তালিকার ২ নম্বর পাতার ৮ নম্বর ক্রমিকে ১০১/৬৮ নম্বর ভিপি কেসের অর্ন্তভূক্ত সম্পত্তি হিসেবে লিপিবদ্ধ আছে।

সাপ্তাহিক তিলোত্তমা পত্রিকার ৩৩ সংখ্যায় লেখা হয়েছে- পুরান ঢাকার লালকুঠি সংলগ্ন ৩৮, নর্থ ব্রুক হল রোডে অবস্থিত এসএ, ৭১৪ আরএস, ১০৭৮ দাগ নং- ১১২, ১ একর ৬২ শতাংশ (এসএ খতিয়ানে ১ একর ২৬ শতাংশ) সরকারের ইজারা প্রদত্ত অর্পিত সম্পত্তি ফেলে দেশান্তরী হয়ে ভারতে অবস্থানরত মূল মালিক তৎকালীন জমিদার দ্বিজেন্দ্র রায় চৌধুরী। তিনি তৎকালীন বৃহত্তম ঢাকা; বর্তমান মানিকগঞ্জ জেলার ধানকোড়ার জমিদার ছিলেন। তিনি শিক্ষিত, পড়াশোনা করেছেন লন্ডনে। সপরিবারে তিনি নর্থ ব্রুক হল রোডের উল্লেখিত সম্পত্তিতে বসবাস করতেন। পাক-ভারত স্বাধীনতার পর ১৯৫৮ সালে জমিদার সপরিবার ভরতের কলকাতায় দেশান্তরী হন এবং ১২৯, সাউদার্ন এভিনিউতে স্থায়ীভাবে বসবাসরত অবস্থায় ১৯৯৭ সালের ৪ মার্চ পরলোক গমন করেন। দ্বিজেন্দ্র রায় চৌধুরী মৃত্যুকালে দুই পুত্র দেবেন্দ্র রায় চৌধুরী ও বাচ্চু রায় চৌধুরী এবং দুই মেয়ে উর্মিলা রায় চৌধুরী মিনু ও সুচন্দা রায় ওরফে মিতা রায় চৌধুরীকে রেখে যান। পরবর্তীতে উর্মিলা রায় চৌধুরী মিনু পরলোক গমন করেন। বর্তমানে দুই ভাই এক বোন কলকাতায় বসবাস করেন। এ জমির প্রকৃত মালিক ভারতীয় নাগরিক হওয়ায় ১৯৬৫ সালে শত্রু সম্পত্তি ও পরবর্তীতে অর্পিত সম্পত্তি হিসাবে সরকারী সম্পত্তির অর্ন্তভূক্ত করা হয়। এ সম্পত্তির মূল মালিক ছিলেন দীনেশ চন্দ্র রায় চৌধুরী। উল্লেখিত তথ্য ছাড়াও, একটি সিএস পর্চা আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে এসেছে। সেখানে লেখা আছে- পরগণা জাহাঙ্গীরনগর, তৌজি নম্বর ৩০০৫, মৌজা শহর ঢাকা, খতিয়ান নং ১০৪৯৯, উপরিস্ত স্বত্ব লাখেরাজ নবীন চন্দ্র দাস, দং গঙ্গাচরণ দাস, অত্র স্বত্ব হেমচন্দ্র রায়, পিতা মৃত গিরিশ চন্দ্র রায়, সাং ধানকোড়া, থানা মানিকগঞ্জ। অর্থাৎ ধানকোড়ার জমিদার দীনেশ চন্দ্র রায় চৌধুরী সপরিবার পুরাণ ঢাকায় বসবাস করতেন এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যাচ্ছে।

ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশে যে কয়টি বড় জমিদারি ছিল তার একটি ছিল ধানকোড়া জমিদারি। অথচ তাদের পরিবারিক ইতিবৃত্ত জানে না খালিয়াজুরি, এমনকি ধানকোড়া এলাকার মানুষ। সাটুরিয়া উপজেলার ধানকোড়া ইউনিয়ন পরিষদ সরকারি ওয়েবসাইটেও উল্লেখযোগ্য তথ্য নেই এই পরিবার সম্পর্কে। অনলাইন বা ইউটিউব ঘেটে যে তথ্য পাওয়া যায় তাতেও রয়েছে ভিন্নমতবাদ। ২০২৪ সালের ২০ ডিসেম্বর মোহাম্মদ ফজল আমিন নামে জনৈক ব্যক্তি তাঁর ফেইসবুক আইডিতে ধানকোড়া জমিদার পরিবার সম্পর্কে লিখেছেন- বাংলাদেশ এর মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলার ধানকোড়া নামক গ্রামে অবস্থিত এক ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি। এই জমিদার বংশধররা ভারতের দিল্লি থেকে বর্তমান বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলায় এসে বসতি স্থাপন করেন এবং জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন। জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জমিদার নরসিংহ রায় চৌধুরী। তারপর জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির আগ পর্যন্ত একে একে জমিদার বংশধররা এই জমিদারীর দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। জমিদার নরসিংহ রায় চৌধুরীর ছেলে ছিলেন গিরিশ গোবিন্দ রায় চৌধুরী। তার ছেলে ছিলেন হেম চন্দ্র রায় চৌধুরী। তার ছিল তিন ছেলে অমূল্য চন্দ্র রায় চৌধুরী, বীরেন চন্দ্র রায় চৌধুরী এবং নির্মল চন্দ্র রায় চৌধুরী। জমিদার বাড়ির পাশেই জমিদাররা একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্যালয়টি জমিদার হেম চন্দ্র তার বাবা জমিদার গিরিশ গোবিন্দের নামে প্রতিষ্ঠা করেন। …বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার জগন্নাথপুর ও খালিয়াজুড়ি নামক এলাকায়ও তাদের জমিদারী ছিল। দেশ ভাগের মধ্য দিয়ে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হলে জমিদার বাড়ির বংশধররা ১৯৫২ সালে ভারতে চলে যান। জনাব মোহাম্মদ ফজল আমিন তাঁর ফেইসবুকে যে তথ্য লিখেছেন অনলাইন ঘাটিয়ে ঘুরে ফিরে এই তথ্যই পাওয়া যায়। ধানকোড়া জমিদারি সম্পর্কে ইউটিউবে অসংখ্যা ভিডিওর থাকলেও আমার দেখা সবগুলো ভিডিওতেই বলা হয়েছে ধানকোড়ার জমিদারদের পূর্বপুরুষ দিল্লি থেকে ধানকোড়া এসেছিলেন, খারিয়াজুরিতে তাদের জমিদারি ছিল। সম্প্রতি এর বাইরে কোনো তথ্য অনলাইন কিংবা অফলাইনে পাওয়া যায়নি। ফলে প্রাচীন বইয়ের সন্ধান করতে হয়েছে। এক্ষেত্রে শ্রীজ্ঞান্দ্রনাথ কুমার সঙ্কলিত ‘বংশ পরিচয় তৃতীয় খন্ড’ বইয়ের ২৫০-২৫৪ পৃষ্টায় ‘ধানকোড়া জমিদার বংশ’ শিরনামে একটি লেখা পাওয়া গেছে। সেখানে ধানকোড়ার জমিদার হেমচন্দ্র রায় চৌধুরীর একটি ছবি এবং তাঁদের বংশলতিকাও রয়েছে। উল্লেখিত বইয়ে ধানকোড়া জমিদার বংশ নিয়ে যা লেখা হয়েছে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় অংশটুকু পাঠকের সুবিধায় এখানে তুলে ধরা হলো- সম্রাট জাহাঙ্গীর ঢাকায় ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে জাহাঙ্গীরনগর স্থাপন করিলে ধানকোড়া জমিদার বংশের পূর্বপুরষ মুকুন্দ চন্দ্র রায় চৌধুরী নামক একজন বংশধর উক্ত সম্রাটের অত্রত্য ঢাকা নগরীতে ১৬২২ খ্রিস্টাব্দে এক হাজার সৈন্যের উপর কর্তৃত্ব ও তিন ‘হাজরা’ উপাধিপ্রাপ্ত হন। তৎকালে তিনি মুকুন্দ হাজরা নামে খ্যাত হন। ইহাদের বাড়ি পূর্বে বরিশাল জিলার অন্তর্গত বাকপুর গ্রামে ছিল। ইহারা রাঢ়ী শ্রেনীর ব্রাহ্মণ বংশিয় ‘বাকপুরের সিমনাই। ইহাদের শেষ পূর্বপুরুষ রাজপ্রসাদ রায় চৌধুরী। তাঁর তিন পুত্র; তন্মধ্যে রাম নরসিংহ রায় চৌধুরী কৃতবিদ্যা ও ভাগ্যবান লোক ছিলেন। মুর্শিদাবাদের শেষ নবাবের আমলে ও ইংরেজ রাজ্যের প্রথম সময় ব্যবসা উপলক্ষ্যে উনি ময়মনসিংহে থাকিতেন। সেই সময় হইতে অতিরিক্ত বিষয় সম্পত্তি খরিদ করেন। তৎকালে কলকাতা বোর্ডে সম্পত্তি নিলাম হইত। …রাম নরসিংহ রায় চৌধুরী মৃত্যুর পর তস্যপুত্র রাজকৃষ্ণ রায় চৌধুরী মহাশয় বহু সম্পত্তি খরিদ করিয়া জমিদারীর আয় বৃদ্ধি করিয়াছিলেন। তাঁর পরলোক গমনের পর তৎপুত্র গিরিশচন্দ্র রায় চৌধুরীর কর্ত্তৃত্ব সময় তিনি বহু সৎকর্ম করেন। ধানকোড়ায় একটি মধ্য ইংরেজি স্কুল স্থাপন করেন। …বাঙ্গালা ও মধ্য ইংরেজি কেন্দ্র ডাইরেকটর সাহেব হইতে লেখা পড়া করিয়া নিজ বাড়িতে আনেন। …গিরিশচন্দ্র রায় চৌধুরী ঢাকায় একটি ছাপাখানা করিয়া ‘বিজ্ঞাপনি ও বার্তাবহ নামে’ একটি সংবাদপত্র চালাইয়া ছিলেন। ইহা ঢাকার প্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা। উহা পরে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা হইতে উঠাইয়া ময়মনসিংহে লইয়া যাওয়া হয়। তথায় উহা কয়েক বৎসর ঐ নামে চলে। পরে তাহার মৃতুল পর পুত্র নাবালক থাকায় সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক উহা উঠাইয়া দেন। পরে স্টেট ১৮৯০ সালে কোর্ট অব ওয়ার্ড হইতে মুক্ত হইলে গিরিশ চন্দ্র রায় চৌধুরীর পুত্র শ্রীযুক্ত হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী মালিক হন। তিনি ১২৭৭ সালের ৩১ জৈষ্ঠ ধানকোড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। …ধানকোড়ার ইংরেজি স্কুলটি প্রায় ত্রিশ হাজার টাকার উপরে খরচ করিয়া হাই স্কুলে ১৯১৭ সালে উন্নীত করিয়া তাহার পিতার নামে গিরিশ ইনস্টিটিউট স্থাপন করিয়াছেন এবং তাহার পত্নীর নামে ঐ স্কুল সংলগ্ন একটি বড় লাইব্রেরি করিয়া দিয়াছেন। …হেম চন্দ্র রায় চৌধুরী তাঁহার পিতা হইতে যে সম্পত্তি পাইয়াছেন তাহা ব্যতীত নতুন সম্পত্তি খরিদ দ্বারা স্টেটের আয় অনেক বৃদ্দি করিয়াছেন। …ইনি মানিকগঞ্জ লোকাল বোর্ড এবং ঢাকা ডিস্ট্রিক বোর্ডের মেম্বার ছিলেন।

শ্রীজ্ঞানেন্দ্রনাথ কুমার সঙ্কলিত বংশ পরিচয় তৃতীয় খন্ড হতে আরো জানা গেছে- ধানকোড়া স্টেট ১৮৯০ সালে কোর্ট অব ওয়ার্ড হইতে মুক্ত হলে গিরিশ চন্দ্র রায় চৌধুরীর পুত্র শ্রীযুক্ত হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী মালিক হয়েছিলেন। ধানকোড়া এস্টেট একসময় কোর্ট অব ওয়ার্ডে ছিল তা প্রতিয়মান হয় ময়মনসিংহ মহাফেজখানায় সংরক্ষিত ১৮৫৬ সালের মহালওয়ার রেজিস্টারে। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত মোঃ হাফিজুর রহমান ভূইঞার বই ময়মনসিংহের জমিদারি ও ভূমিস্বত্ব ১৮৫৪-১৯৬০ গ্রন্থের ১০৮ পৃষ্টা থেকে জানাযায়- ১৮৫৬ সালে খালিয়াজুরি পরগণায় ষোল আনা হিস্যা জমিদারির মধ্যে ৭ আনা ১৫ গন্ডা ২ কড়া ১ ক্রান্তি ১০ তিল হিস্যার জমিদার ছিলেন রামমনি ও ব্রজমনি দেব্যা। চার গন্ডা হিস্যা জমিদার ছিলেন মাহমদনেইন। অবশিষ্ট আট আনা হিস্যা জমিদার ছিলেন খাজে খাতক সেতাকালি। সেখানে রামমনি ও ব্রজমনি দেব্যা সহ অন্যান্য মালিকগণের পরিচয় লেখা নেই। তবে হিস্যা বিবেচনায় সকলের পরিচয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেলেও শ্রীজ্ঞানেন্দ্রনাথ কুমার সঙ্কলিত বংশ পরিচয় তৃতীয় খন্ড প্রমাণ করে রামমনি ও ব্রজমনি দেব্যা ধানকোড়া জমিদারের পত্নী। ধানকোড়া জমিদার-পুত্রগণ নাবালক থাকায় এস্টেট কোর্ট অব ওয়ার্ডের নিয়ন্ত্রনে ছিল বিধায় মহালওয়ার রেজিস্টারে মালিক হিসেবে জমিদার পত্নীদের নাম লিপিবদ্ধ হয়েছে। ইতোপূর্বে এই লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে ১৮৫৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত খালিয়াজুরির পরগণার ৭ আনা ১৫ গন্ডা ২ কড়া ১ ক্রান্তি ১০ তিল হিস্যার জমিদার ছিলেন ধানকোড়ার জমিদার। ১৮৫৬ সালের পর খাজে ওয়ালিসের উত্তরাধিকার দুই মেয়ের মধ্যে এক মেয়ের চার আনা হিস্যা জমিদারি ক্রয়সূত্রে মালিক হন ধানকোড়ার জমিদার, অবশিষ্ট চার আনা হিস্যা ক্রয়য়সূত্রে মালিক হন টাঙ্গাইল জেলার কড়টিয়ার জমিদার। অর্থাৎ ১৮৫৬ সালের পর খালিয়াজুরি পরগণার ষোল আনা জমিদারির মধ্যে ১১ আনা ১৫ গন্ডা ২ কড়া ১ ক্রান্তি ১০ তিল হিস্যার মালিক হন ধানকোড়ার জমিদার, ৪ আনা হিস্যার মালিক হন কড়টিয়ার জমিদার এবং ৪ গন্ডা হিস্যার মালিক ছিলেন কদমশ্রীর জমিদার। ১৯১৭ সালে অনুষ্ঠিত সিএস রেকর্ড অনুযায়ি খালিয়াজুরি পরগণায় ধানকোড়া এস্টেটের জমিদার ছিলেন দিনেশচন্দ্র রায় চৌধুরী এবং হেম চন্দ্র রায় চৌধুরী। ১৯৫২ সালের এসএ রেকর্ড অনুযায়ি জমিদার ছিলেন দীনেশচন্দ্র রায় চৌধুরীর স্ত্রী উষারানী রায় চৌধুরী। সর্বোপরি জমিদারি অধিগ্রহণ সময় খালিয়াজুরি পরগণা ধানকোড়া এস্টেট ২ এর জমিদার ছিলেন দ্বিজেশ চন্দ্র রায় চৌধুরী। তবে ধানকোড়া এস্টেট ১ অর্থাৎ হেম চন্দ্র রায় চৌধুরীর হিস্যা সম্ভবত সমর্পন করা হয়নি বিধায় জমিদারি অধিগ্রহণ রেজিস্টারে এই অংশের উল্লেখ নাই। মোট কথায়- ১৭৯৮ সালের পর খালিয়াজুরি পরগণার ৭ আনা ১৫ গন্ডা ২ কড়া ১ ক্রান্তি ১০ তিল হিস্যা ক্রয়সূত্রে মালিক হন ধানকোড়া জমিদার। ১৮৫৬ সালের পর আরো চার আনা হিস্যা ক্রয়সূত্রে মালিক হন। এভাবেই, জমিদারি অধিগ্রহণ সময় পর্যন্ত খালিয়াজুরি পরগণায় মোট জমিদারি অর্থাৎ ৮২ হাজার ০৭৭ একর বা ১৩০ বর্গমাইল ভূখন্ডের সর্বমোট ১১ আনা ১৫ গন্ডা ২ কড়া ১ ক্রান্তি ১০ তিল হিস্যার মালিক ছিলেন ধানকোড়ার জমিদার। এই জমিদারগণের বসত বাড়ি ছিল মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলার খল্লি ধানকোড়া মৌজায়। সেখানে এই জমিদারদের বসতবাড়ির ভগ্নাবশেষ বিদ্যমান আছে। পরবর্তীতে এই জমিদারগণ সূত্রাপুর থানার পুরান ঢাকার লালকুঠি সংলগ্ন বাসায় অতঃপর দেশভাগের পর ভরতের কলকাতায় ১২৯ সাউদার্ন এভিনিউতে স্থানান্তরিত হন। ১৭৯৮ সালের পর থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত খালিয়াজুরি পরগণার বড় অংশ ধানকোড়া এস্টেটের জমিদারি ছিল।

লিখেছেন : ফারুকুর রহমান চৌধুরী,কবি ও গীতিকার বাংলাদেশ বেতার এবং বহুমাত্রিক লেখক।


Share Option;

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *