“প্রথম পর্ব”
আন্দোলন ছোট্ট এটি শব্দ যার অর্থ নড়া ছড়া করা। স্থীর থাকার নাম আন্দোলন নয়, চলার নাম, গতি সৃষ্টির নাম, অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নাম হচ্ছে আন্দোলন। ইংরেজিতে যাকে Movement ও Protest বলা হয়।
Movement সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয় বৃহত্তর সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের জন্য সংঘটিত একটি প্রচেষ্টাকে বোঝাতে।
ক্ষমতাশালীদের দ্বারায় নিষ্পেষিত অধিকার বন্ঞ্চিত মানুষ নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে প্রচেষ্টা চালায় তাহাই আন্দোলন। আরেকটু সহজ করে বলতে গেলে –
সমাজে প্রতিষ্ঠিত যে নিয়ম পদ্ধতি সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে ব্যার্থ, সে নিয়ম পদ্ধতি পরিবর্তনের এক বিপ্লবী কর্মসূচির নাম আন্দোলন।
সুতরাং, আন্দোলন কেবল কোনো দাবিদাওয়ার সংগ্রাম নয়,এটি এক জাতির আত্মপ্রকাশ, এক জনতার প্রাণের আর্তি। এটি সেই দীপ্ত আলো, যা অন্ধকারে আশার পথ দেখায়। আন্দোলনই পরিবর্তনের সেতুবন্ধন—একটি নতুন ভোরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অবিচল সংকল্প।
আর Protest ব্যবহার হয় প্রতিবাদমূলক কাজ বোঝাতে, যা সাধারণত তাৎক্ষণিক বা নির্দিষ্ট কোনো ঘটনার বিরুদ্ধে হয়ে থাকে।
আন্দোলনের উপাদান:
সমাজের মৌলিক পরিবর্তন বা আংশিক পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন করতে হলে তার কিছু উপাদান থাকা চাই। যেমন:
সুস্পষ্ট দাবি বা উদ্দেশ্য :
যে কোন আন্দোলনের সুস্পষ্ট দাবি ও উদ্দেশ্য পরিস্কার থাকা আবশ্যক। সু নির্দিষ্ট দাবি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে। এবং শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে সহায়ক হয়। যাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে তাদের কাছে স্পষ্ট মেসেজ পৌঁছে। দাবী পুরন হোক বা না হোক তাদের ভূমিকা সম্পর্কে জানা যায়। সুস্পষ্ট দাবি ছাড়া আন্দোলন দিকহীন নৌকার মতো, যা কোনো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না।
আমরা যে আন্দোলনের কথা আলোচনা করতে যাচ্ছি তা হলো দুনিয়ার মানুষের জন্য একটি কল্যানমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।যার সূচনা হয়েছে আম্বিয়া আলাইহিস সালামদের মাধ্যমে।
বলিষ্ঠ ও যোগ্য নেতৃত্ব: আন্দোলনের সফলতার জন্য একজন বা একাধিক নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী থাকা আবশ্যক, যাদের দিকনির্দেশনা আন্দোলন পরিচালিত হবে। যিনি হবেন-দূরদর্শী, সৎ ও ন্যায়পরায়ণ, সকলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার যোগ্যতা সম্পন্ন ,
দল পরিচালনার যোগ্য, সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী,সময় ও পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া ক্ষমতা সম্পন্ন।
মানুষের মধ্যে গ্রহণ যোগ্যতা : যে কোন
আন্দোলন সফল করতে হলে সাধারণ মানুষের গ্রহণ যোগ্যতা ও সমর্থন প্রয়োজন। আমাদের আন্দোলনের
জনসমর্থন বৃদ্ধি পাক বা না পাক এটাকে নিয়ে আমরা বেশী পেরেশান না হয়ে নিয়মিত দাওয়াতি কাজ করার দিকে মনোযোগী হওয়া দরকার। তবে যে সমাজের বেশীরভাগ মানুষের আমাদের দাওয়াতের বিরোধিতা করবেনা সে সমাজে আন্দোলনের সফলতা অর্জন সম্ভব।
আমাদের সাথে একমত না হলেও যদি আমাদের বিরোধিতা না করে তবে এটা বুঝে নিতে হবে যে আমাদের যৌক্তিক ও প্রয়োজনীয় মানব কল্যানমুখী আন্দোলনের গ্রহণ যোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সুশৃঙ্খল সংগঠন : আন্দোলনকে স্থায়ী ও সফল করতে শৃঙ্খলা অপরিহার্য। নেতৃত্ব ও কর্মীদের সাথে গভীর শ্রদ্ধা ও স্নেহময় সম্পর্ক থাকবে। যাতে নেতার নির্দেশকে খুশী মনে হাসি মুখে গ্রহণ করতে পারে। সকল কাজে চেইন অব কমান্ড মেন্টেইন করে চলে। আন্দোলন সফল করতে এমন সুশৃঙ্খল সংগঠনের প্রয়োজন।
কর্মপন্থা বা কর্মকৌশল:
আন্দোলন কীভাবে পরিচালিত হবে? তার জন্য একটি কর্মপন্থা থাকা জরুরী। সমাজের নেতৃত্ব পরিবর্তনের আন্দোলনের একটি স্থায়ী কর্মপন্থা থাকা আবশ্যক। এবং কর্মপন্থা নির্ধারণে জনকল্যাণের কথা মাথায় রেখে ঠিক করা।
যোগাযোগ ও প্রচার: যে কোন আন্দোলন সফল করতে হলে তার ন্যায্যতা বা উপকারীতা সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করা। প্রতিষ্ঠিত আইন ও শাসন ব্যবস্থার সাথে আন্দোলনের যৌক্তিকতা, মানুষদেরকে আন্দোলনে শরিক করা এবং বিভিন্ন মিথ্যাচারের সঠিক জবাব দেওয়ার জন্য একটা প্রচার টীম বা প্রচার মাধ্যম থাকা আবশ্যক। অনেক সময় সঠিক বুঝ না থাকার করানে অনেকে এই প্রচার প্রচারণাকে নিরুৎসাহিত করে। যার কারণে যৌক্তিক আন্দোলনও সফল হতে পারেনা। অথচ আল্লাহ বলেন
তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, সৎকাজের আদেশ দিবে ও অসৎ কাজে বাধা দিবে।”
— [সূরা আলে ইমরান, ৩:১০৪]
দমন নিপীড়নের প্রতিরোধ কৌশল :
আন্দোলন যাদের বিপক্ষে যাবে তারা সবসময়ই দমন করার চেষ্টা করবে। শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হলে তো নিপীড়ন মাত্রা চরম আকার ধারণ করে। যেমন গ্রেফতার, নির্যাতন, ভীতি প্রদর্শন, অপপ্রচার, নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি। এর মূল উদ্দেশ্য আন্দোলনকারীদের মনোবল ভেঙে দেওয়া এবং সাধারণ মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা।
আন্দোলন সফল করতে যে সকল কৌশল অবলম্বন করা দরকার :
১.মনোবল অটুট রাখা:
দমন-নিপীড়ন ঠেকাতে প্রথম ও প্রধান কৌশল হলো আত্মিক শক্তি ও মনোবল দৃঢ় রাখা। ভয়-ভীতি, নির্যাতন যেন আদর্শ থেকে বিচ্যুতি ঘটাতে না পারে।
২.বিকল্প কৌশল গ্রহণ:
প্রকাশ্য আন্দোলনের পাশাপাশি নিরাপদ ও বুদ্ধিদীপ্ত
বিকল্প পদ্ধতিতে বার্তা প্রচার ও সংগঠন চালিয়ে যাওয়া (যেমন: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতনতা, সাংস্কৃতিক উপায়ে বার্তা পৌঁছানো)।
৩.আইনগত ও সাংবিধানিক অধিকার ব্যবহার:
যেখানে সম্ভব, আন্দোলনের ন্যায্যতা তুলে ধরে আইনি লড়াই চালানো।
৪.আন্তর্জাতিক জনমত গঠন:
নিপীড়নের বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরা; যেন সরকার বা দমনকারী গোষ্ঠী চাপে পড়ে যায়।
৫.সংগঠনের অভ্যন্তরে ঐক্য বজায় রাখা:
দমন-পীড়নের সময়ে বিভক্তি আন্দোলনের বড় দুর্বলতা। তাই নেতৃত্বে আস্থা, পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা, এবং সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে নিবিড় অনুগত্য করে যাওয়া অত্যান্ত জরুরি।
ইসলামী আন্দোলন:-
ইসলামী আন্দোলন হচ্ছে এমন একটি চিন্তা, কর্ম ও সংগ্রামের ধারা। যার মূল লক্ষ্য হলো ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনের সর্বস্তরে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ বিধান প্রতিষ্ঠা করা। এটি একটি দাওয়াতি, আদর্শভিত্তিক ও বিপ্লবী প্রচেষ্টা, যা কেবলমাত্র কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, বরং নৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রূপান্তর ঘটিয়ে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন করার নাম। যা প্রথমে ব্যক্তিকে সংশোধন এবং পরবর্তীতে সমাজ ও রাষ্ট্রকে পরিবর্তন করে।
ইসলামী আন্দোলনের মূল কাজ হল মানুষকে আল্লাহর গোলামী করার দিকে আহবান করতে থাকা এবং আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করার প্রান পন চেষ্টা করা। এ প্রসঙ্গে
আল কুরআনের বক্তব্য তুলে ধরছি। আল্লাহ বলেন :
قُلْ هٰذِهٖ سَبِیْلِیْۤ اَدْعُوْۤا اِلَى اللّٰهِ١ؔ۫ عَلٰى بَصِیْرَةٍ اَنَا وَ مَنِ اتَّبَعَنِیْ١ؕ وَ سُبْحٰنَ اللّٰهِ وَ مَاۤ اَنَا مِنَ الْمُشْرِكِیْنَ
হে নবী : তাদেরকে পরিষ্কার বলে দাওঃ আমার পথতো এটাই, আমি আল্লাহর দিকে ডাকি, আমি নিজেও পূর্ণ আলোকে নিজের পথ দেখছি এবং আমার সাথীরাও। আর আল্লাহ পাক-পবিত্র এবং শিরককারীদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। (ইউসুফ, আয়াত: ১০৮)
لَاۤ اِكْرَاهَ فِی الدِّیْنِ١ۙ۫ قَدْ تَّبَیَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَیِّ١ۚ فَمَنْ یَّكْفُرْ بِالطَّاغُوْتِ وَ یُؤْمِنْۢ بِاللّٰهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقٰى١ۗ لَا انْفِصَامَ لَهَا١ؕ وَ اللّٰهُ سَمِیْعٌ عَلِیْمٌ
দ্বীনের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি নেই। ভ্রান্ত মত ও পথ থেকে সঠিক মত ও পথকে ছাঁটাই করে আলাদা করে দেয়া হয়েছে। এখন যে কেউ তাগুতকে অস্বীকার করে আল্লাহর ওপর ঈমান আনে, সে এমন একটি মজবুত অবলম্বন আঁকড়ে ধরে, যা কখনো ছিন্ন হয় না। আর আল্লাহ (যাকে সে অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে ধরেছে) সবকিছু শোনেন ও জানেন। (আল-বাক্বারাহ, আয়াত: ২৫৬)
وَ اَنِ احْكُمْ بَیْنَهُمْ بِمَاۤ اَنْزَلَ اللّٰهُ وَ لَا تَتَّبِعْ اَهْوَآءَهُمْ وَ احْذَرْهُمْ اَنْ یَّفْتِنُوْكَ عَنْۢ بَعْضِ مَاۤ اَنْزَلَ اللّٰهُ اِلَیْكَ١ؕ فَاِنْ تَوَلَّوْا فَاعْلَمْ اَنَّمَا یُرِیْدُ اللّٰهُ اَنْ یُّصِیْبَهُمْ بِبَعْضِ ذُنُوْبِهِمْ١ؕ وَ اِنَّ كَثِیْرًا مِّنَ النَّاسِ لَفٰسِقُوْنَ
কাজেই হে মুহাম্মাদ! তুমি আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী তাদের যাবতীয় বিষয়ের ফায়সালা করো এবং তাদের খেয়ালখুশীর অনুসরণ করো না। সাবধান হয়ে যাও, এরা যেন তোমাকে ফিতনার মধ্যে নিক্ষেপ করে সেই হেদায়াত থেকে সামান্যতমও বিচ্যুত করতে না পারে, যা আল্লাহ তোমার প্রতি নাযিল করছেন। যদি এরা এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে জেনে রাখো, আল্লাহ এদের কোন কোন গোনাহর কারণে এদেরকে বিপদে ফেলার সিদ্ধান্তই করে ফেলেছেন। আর যথার্থই এদের অধিকাংশ ফাসেক।
(আল-মায়িদাহ, আয়াত: ৪৯)
شَرَعَ لَكُمْ مِّنَ الدِّیْنِ مَا وَصّٰى بِهٖ نُوْحًا وَّ الَّذِیْۤ اَوْحَیْنَاۤ اِلَیْكَ وَ مَا وَصَّیْنَا بِهٖۤ اِبْرٰهِیْمَ وَ مُوْسٰى وَ عِیْسٰۤى اَنْ اَقِیْمُوا الدِّیْنَ وَ لَا تَتَفَرَّقُوْا فِیْهِ١ؕ كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِیْنَ مَا تَدْعُوْهُمْ اِلَیْهِ١ؕ اَللّٰهُ یَجْتَبِیْۤ اِلَیْهِ مَنْ یَّشَآءُ وَ یَهْدِیْۤ اِلَیْهِ مَنْ یُّنِیْبُ
তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের সেই সব নিয়ম-কানুন নির্ধারিত করেছেন যার নির্দেশ তিনি নূহকে দিয়েছিলেন এবং (হে মুহাম্মাদ) যা এখন আমি তোমার কাছে অহীর মাধ্যমে পাঠিয়েছি। আর যার আদেশ দিয়েছিলাম আমি ইবরাহীম (আ), মূসা (আ) ও ঈসাকে (আ) । তার সাথে তাগিদ করেছিলাম এই বলে যে, এ দ্বীনকে কায়েম করো এবং এ ব্যাপারে পরস্পর ভিন্ন হয়ো না। (হে মুহাম্মাদ) এই কথাটিই এসব মুশরিকের কাছে অত্যন্ত অপছন্দনীয় যার দিকে তুমি তাদের আহবান জানাচ্ছো। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা আপন করে নেন এবং তিনি তাদেরকেই নিজের কাছে আসার পথ দেখান যারা তাঁর প্রতি রুজু করে।
(আশ-শূরা, আয়াত: ১৩)
هُوَ الَّذِیْۤ اَرْسَلَ رَسُوْلَهٗ بِالْهُدٰى وَ دِیْنِ الْحَقِّ لِیُظْهِرَهٗ عَلَى الدِّیْنِ كُلِّهٖ١ۙ وَ لَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُوْنَ
আল্লাহই তার রসূলকে পথনির্দেশ ও সত্য দ্বীন সহকারে পাঠিয়েছেন যাতে তিনি একে সকল প্রকার দ্বীনের ওপর বিজয়ী করেন, মুশরিকরা একে যতই অপছন্দ করুক না কেন। (আত-তওবা, আয়াত: ৩৩)
ইসলামী আন্দোলন হচ্ছে আল্লাহর দেওয়া নির্দেশ গুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্ত নির্দেশ। যা ব্যক্তি সংশোধন থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বস্তরে ইসলামের প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত বিস্তৃত এক পূর্ণাঙ্গ বিপ্লবী কর্মসূচি। এ আন্দোলনের মাধ্যমে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী একটি কল্যাণময় সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে।
ইসলামী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য� :
আমাদের সমাজে বহু আন্দোলনে রয়েছে কিন্ত কোনটাকে আমরা ইসলামী আন্দোলন মনে করবো?
নেতৃত্বের মুখে চমকপ্রদ কথা শুনে সমাজের বন্ঞ্চিত নিপিড়ীত মানুষ আকৃষ্ট হয়ে পড়ে । আর ধর্ম প্রাণ মানুষ ইসলাম ও নবী রাসুলের কথা শুনলে তো কথাই নেই!
আমি এ পয়েন্টে কোন আন্দোলন করা ফরজ! কি তার বৈশিষ্ট্য তা তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
আল্লাহ যে আন্দোলন করার নির্দেশ দিয়েছেন তা হবে-
কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশিত পথে সমাজে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য বদ্ধপরিকর। যার মুল লক্ষ্য হবে একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সমাজ, রাষ্ট্র ও সভ্যতা গঠন করা—যেখানে ইমান, আমল ও ইনসাফ হবে চালিকা শক্তি।
ক। যারা তাওহীদ রিসালাত ও আখেরাত এর উপর পূর্ণ আস্থা রাখেন। যাদের মনে মননে কাজে কর্মে আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রাধান্য পায়। আল্লাহ বলেন :
قُلْ اِنَّ صَلَاتِیْ وَ نُسُكِیْ وَ مَحْیَایَ وَ مَمَاتِیْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَۙ
বলো, আমার নামায, আমার ইবাদাতের সমস্ত অনুষ্ঠান, আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছু আল্লাহ রব্বুল আলামীনের জন্য,( আল-আনয়াম, আয়াত: ১৬২)
খ। যারা সু সংঘবদ্ধভাবে সাংগঠন পরিচালনা করেন। কর্মীরা আমিরের আনুগত্য করেন এবং আমির সিদ্ধান্ত গ্রহণে শুরার সাথে মাসোয়ারা করেন। যে কোন বিষয়ে মতানৈক্য থাকলেও শুরার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যান।
গ। যারা একসাথে সবকিছু চাপিয়ে দেন না। বরং পরিবেশ তৈরী করে যৌক্তিকতার ভিত্তিতে প্রয়োজনের আলোকে পরিবর্তন করেন। আল্লাহ বলেন:
وَ لْتَكُنْ مِّنْكُمْ اُمَّةٌ یَّدْعُوْنَ اِلَى الْخَیْرِ وَ یَاْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَ یَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ١ؕ وَ اُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ
তোমাদের মধ্যে এমন কিছু লোক অবশ্যই থাকতে হবে, যারা নেকী ও সৎকর্মশীলতার দিকে আহবান জানাবে, ভালো কাজের নির্দেশ দেবে ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখবে। যারা এ দায়িত্ব পালন করবে তারাই সফলকাম হবে। (আলে-ইমরান, আয়াত: ১০৪)
কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিতে ধৈর্য, হিকমাহ ও ধাপে ধাপে সমাজ পরিবর্তনের মাধ্যমে কাজ করেন
ঘ। নৈতিকতা ও আত্নশুদ্ধির প্রতি যারা যত্নবান হবেন।রাসুলুল্লাহ সা: প্রথমে চরিত্র গঠন, ইমান ও তাকওয়ার চর্চায় গুরুত্ব দিয়েছেন।
ঙ। যারা বৈপ্লবিক পরিবর্তন করতে গিয়ে মানবাধিকারের বিষয়ে সচেতন থাকেন।
রাসূল (সাঃ) এর মাক্কী যুগে শান্তিপূর্ণ সুন্নাতি প্রদ্ধতিকে অনুসরণ করেন।
চ। যাদের মুল লক্ষ্য হবে একটি ইসলামী কল্যানমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। ব্যক্তির কতৃত্ব বা প্রতিষ্ঠা নয়,বরং আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে প্রয়োজনে নিজের জীবন বিলয়ে দিবেন। যারা সবসময়ই নিজের খেয়াল খুশী ও খায়েশের চাইতে শরিয়াহকে প্রাধান্য দেয়।
ছ। যাদের কাছে ক্ষমতা হবে খেদমতের জন্য দায়িত্ব ও আমানত। ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার এক গুরু দায়িত্ব যার জবাব জনগণ ও মহান আল্লাহর কাছে দেওয়ার ভয়েভীত থাকে। আল্লাহ বলেন :
اِنَّ اللّٰهَ یَاْمُرُكُمْ اَنْ تُؤَدُّوا الْاَمٰنٰتِ اِلٰۤى اَهْلِهَا١ۙ وَ اِذَا حَكَمْتُمْ بَیْنَ النَّاسِ اَنْ تَحْكُمُوْا بِالْعَدْلِ١ؕ اِنَّ اللّٰهَ نِعِمَّا یَعِظُكُمْ بِهٖ١ؕ اِنَّ اللّٰهَ كَانَ سَمِیْعًۢا بَصِیْرًا
হে মুসলিমগণ! আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় আমানত তার হকদারদের হাতে ফেরত দেবার নির্দেশ দিচ্ছেন। আর লোকদের মধ্যে ফায়সালা করার সময় “আদল” ও ন্যায়নীতি সহকারে ফায়সালা করো। আল্লাহ্ তোমাদের বড়ই উৎকৃষ্ট উপদেশ দান করেন। আর অবশ্যই আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও দেখেন। (আন-নিসা, আয়াত: ৫৮)
এই গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লবীর কর্মসূচি একা-একা পালন করার বিষয় নয়। এর জন্য প্রয়োজন সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা, প্রয়োজন সংগঠনের।
সংগঠন :
সংগঠন হলো একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য বা আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য সুশৃঙ্খল ও দায়িত্বশীল কিছু মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার নাম। শুধুমাত্র কিছু মানুষ একত্রিত হলেই সংগঠন হয়ে যায় না। এর জন্য প্রয়োজন আদর্শভিত্তিক ও লক্ষ্যনির্ভর কর্মপ্রবাহ এবং সেই কর্ম বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বশীলতা।
আমাদের সমাজে Formal ও Informal—দুই ধরনের অনেক সংগঠন রয়েছে। এদের সবারই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে।
সংগঠনের উপাদানসমূহ:
সংগঠনকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা ও সুচারুভাবে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে যেসব মৌলিক উপাদান প্রয়োজন, তা হলো—
১. নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
২. একনিষ্ঠ কর্মীবাহিনী
৩. সাংগঠনিক কাঠামো
৪. যোগ্য নেতৃত্ব
৫. সাংগঠনিক নিয়মনীতি
৬. নির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্র
৭. অর্থ/সম্পদ
সংগঠন যদি এসব মৌলিক উপাদানের সমন্বয়ে পরিচালিত হয়, তাহলে তা নিজ লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হবে।
উদাহরণস্বরূপ:
একটি চলন্ত বাস যদি নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাতে চায়, তাহলে প্রয়োজন—দক্ষ চালক, অনুগত সহকারী (হেলপার/কন্ডাক্টর), ভালো ইঞ্জিন, জ্বালানি এবং উপযুক্ত রাস্তা। এই উপাদানগুলোর কোনো একটি অনুপস্থিত হলে দুর্ঘটনায় পতিত হওয়াটা স্বাভাবিক।
তেমনি, সংগঠনের ক্ষেত্রেও উপযুক্ত উপাদান ছাড়া সংগঠন পরিচালনা করতে গেলে ব্যর্থতা বা দুর্ঘটনা অনিবার্য।
ইসলামী সংগঠন:
ইসলামী সংগঠনের মূল লক্ষ্য হলো—মানুষকে আল্লাহর প্রকৃত গোলাম বানানো এবং সামাজিকভাবে আল্লাহর বিধান কায়েমের মাধ্যমে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এটি কোনো সাধারণ সংঘ বা সংগঠনের মতো নয়।
ইসলামী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত থাকা আল্লাহর নির্দেশ।
পবিত্র কুরআনে অনেক জায়গায় আল্লাহ তাআলা এই বিষয়ে স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন, সুরা আল-ইমরান এর ১০৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন:
وَ اعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللّٰهِ جَمِیْعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوْا١۪ وَ اذْكُرُوْا نِعْمَتَ اللّٰهِ عَلَیْكُمْ اِذْ كُنْتُمْ اَعْدَآءً فَاَلَّفَ بَیْنَ قُلُوْبِكُمْ فَاَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهٖۤ اِخْوَانًا١ۚ وَ كُنْتُمْ عَلٰى شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ النَّارِ فَاَنْقَذَكُمْ مِّنْهَا١ؕ كَذٰلِكَ یُبَیِّنُ اللّٰهُ لَكُمْ اٰیٰتِهٖ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُوْنَ
তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রুজ্জু মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো এবং দলাদলি করো না। আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন সে কথা স্মরণ রেখো। তোমরা ছিলে পরস্পরের শত্রু। তিনি তোমাদের হৃদয়গুলো জুড়ে দিয়েছেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহ ও মেহেরবানীতে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেছো। তোমরা একটি অগ্নিকুণ্ডের কিনারে দাঁড়িয়ে ছিলে। আল্লাহ সেখান থেকে তোমাদের বাঁচিয়ে নিয়েছেন। এভাবেই আল্লাহ তাঁর নির্দশনসমূহ তোমাদের সামনে সুস্পষ্ট করে তুলেন। হয়তো এই নিদর্শনগুলোর মাধ্যমে তোমরা নিজেদের কল্যাণের সোজা সরল পথ দেখতে পাবে।
وَ لْتَكُنْ مِّنْكُمْ اُمَّةٌ یَّدْعُوْنَ اِلَى الْخَیْرِ وَ یَاْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَ یَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ١ؕ وَ اُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ
তোমাদের মধ্যে এমন কিছু লোক অবশ্যই থাকতে হবে, যারা নেকী ও সৎকর্মশীলতার দিকে আহবান জানাবে, ভালো কাজের নির্দেশ দেবে ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখবে। যারা এ দায়িত্ব পালন করবে তারাই সফলকাম হবে। (আলে-ইমরান, আয়াত: ১০৪)
كُنْتُمْ خَیْرَ اُمَّةٍ اُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَاْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَ تَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَ تُؤْمِنُوْنَ بِاللّٰهِ١ؕ وَ لَوْ اٰمَنَ اَهْلُ الْكِتٰبِ لَكَانَ خَیْرًا لَّهُمْ١ؕ مِنْهُمُ الْمُؤْمِنُوْنَ وَ اَكْثَرُهُمُ الْفٰسِقُوْنَ
এখন তোমরাই দুনিয়ায় সর্বোত্তম দল। তোমাদের কর্মক্ষেত্রে আনা হয়েছে মানুষের হিদায়াত ও সংস্কার সাধনের জন্য। তোমরা নেকীর হুকুম দিয়ে থাকো, দুষ্কৃতি থেকে বিরত রাখো এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনো। এই আহলি কিতাবরা ঈমান আনলে তাদের জন্যই ভালো হতো। যদিও তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক ঈমানদার পাওয়া যায়; কিন্তু তাদের অধিকাংশই নাফরমান। (আলে-ইমরান, আয়াত: ১১০)
অতএব এটা কোন নফল কাজ নয় যে মন চাইলে ইসলামী সংগঠনের সাথে থাকলাম মন চাইলো না থাকলাম না। রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন
عَنِ الْحَارِثِ الأَشْعَرِيّ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: وَأَنَا آمُرُكُمْ بِخَمْسٍ اللَّهُ أَمَرَنِي بِهِنَّ: الْجَمَاعَةَ السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ وَالْهِجْرَةُ وَالْجِهَادِ فِي سَبِيلِ اللهِ فَإِنَّهُ مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ قِيدَ شِبْرٍ فَقَدْ خَلَعَ رِبْقَةَ الْإِسْلَامِ مِنْ عُنُقِهِ إِلَّا أَنْ يَرْجِعَ, وَمَنْ ادَّعَى دَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ فَإِنَّهُ مِنْ جُثَا جَهَنَّمَ, فَقَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللَّهِ وَإِنْ صَلَّى وَصَامَ؟ قَالَ: وَإِنْ صَامَ وَصَلَّى وَزَعَمَ أَنَّهُ مُسْلِمٌ – (مسند احمد
(ترمذی)
হযরত হারিসুল আশয়ারী রা. থেকে বর্ণিত। নবী করীম সা. বলেছেন, আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ের নির্দেশ দিচ্ছি যেগুলোর ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। ১. জামায়াতবদ্ধ হবে ২. নেতার আদেশ মন দিয়ে শুনবে ৩. তার আদেশ মেনে চলবে ৪. আল্লাহর পথে হিজরত করবে ৫. আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে। আর তোমাদের মধ্য হতে যে সংগঠন হতে বিঘত পরিমাণ দূরে সরে গেল, সে তার গর্দান থেকে ইসলামের রশি খুলে ফেলল তবে যদি ফিরে আসে তা ভিন্ন কথা। আর যে ব্যক্তি জাহেলিয়াতের দিকে আহ্বান জানায় সে জাহান্নামি। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! সে যদি রোজা রাখে, নামাজ পড়ে এরপরও? রসূল সা. বললেন, যদি রোজা রাখে, নামাজ পড়ে এবং নিজেকে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করে এরপরও জাহান্নামি হবে। (আত তিরমিযি : ২৮৬৩.)
চলবে —
বই- দাঈ ও সংগঠক- লেখক – আবু নাঈম মু শহীদুল্লাহ্