ইসলামী সংগঠনের গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য :
মুহাম্মাদ (সাঃ) আখেরী নবী এবং তার উপর নাযিল হওয়া আসমানী কিতাব আল কুরআন সর্বশেষ হেদায়েত গ্রন্থ। এ কথা যারা বিশ্বাস করে তারা ব্যক্তি জীবন ও সামাজিকভাবে ইসলামকে প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবে এটা আল্লাহর নির্দেশ। আর এ নির্দেশ একা করার কথা বলেননি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন, সংঘবদ্ধভাবে করতে বলেছেন। সংঘবদ্ধ উদ্যোগ ছাড়া
ইসলামের শ্ৰেষ্ঠত্ব ও সৌন্দর্য বিকাশ সাধন সম্ভবপর নয় ।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন –
وَ اعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللّٰهِ جَمِیْعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوْا
তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রুজ্জু মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো এবং দলাদলি করো না।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরো বলেন :
وَ مَنْ یَّعْتَصِمْ بِاللّٰهِ فَقَدْ هُدِیَ اِلٰى صِرَاطٍ مُّسْتَقِیْمٍ۠
যারা সংঘবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ করবে, মূলত তাদের জন্যই রয়েছে সিরাতুল মুসতাকীম বা সহজ পথের দিশা। (সূরা আলে ইমরান: ১০১)
হযরত উমর (রা) বলেন-
لاً اسلام الأ بجماعة ولاً جماعة الأ بامارة والأ امارة الأ بطاعة۔
“সংগঠন ছাড়া ইসলাম নেই, নেতৃত্ব ছাড়া সংগঠন নেই, আনুগত্য ছাড়া ইসলাম নেই।
রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন-
اذا خرج ثلاثة فی سفر فليؤمروا عليهم أحدهم –
“তিনজন লোক সফরে বের হলে তারা যেন তাদের একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়।” – সুনানে আবু দাউদ
و من مات وهو مفارق للجماعة فائه يموت ميتة جاهلية –
যেই ব্যক্তি জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে তার মৃত্যু হবে জাহিলিয়াতের মৃত্যু।(সহীহ মুসলিম)
ঈমানের স্বাদ পাওয়া কোন ব্যাক্তি জাহিলিয়াতের মৃত্যু চায় না। কারন ঈমানদারের মূল লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে জান্নাত প্রাপ্তি। সংঘবদ্ধ হয়ে ইকামাতে দ্বীনের কাজ করলে আল্লাহ ভালবাসা পাওয়া যায়।
সুরা আস-সফের ৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন :
اِنَّ اللّٰهَ یُحِبُّ الَّذِیْنَ یُقَاتِلُوْنَ فِیْ سَبِیْلِهٖ صَفًّا كَاَنَّهُمْ بُنْیَانٌ مَّرْصُوْصٌ
আল্লাহ সেই সব লোকদের ভালবাসেন যারা- তাঁর পথে এমনভাবে কাতারবন্দী হয়ে লড়াই করে, যেন তারা সীসা গলিয়ে ঢালাই করা এক মজবুত দেয়াল। সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত না থাকলে ইসলাম পুরোপুরি মেনে চলা অনেক কঠিন। ইসলামী সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া কোন সখের ব্যাপার নয়। এটা একটা চ্যালেন্জিং বিষয়; তারপরও ঈমানের অনিবাৰ্য দাবী হচ্ছে সংঘবদ্ধ জীবন-যাপন ।
ঈমানের দাবী পূরনের লক্ষ্যে যারা সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হবেন, আল্লাহ তাদেরকে নেয়ামত দিয়ে ভরপুর করে দিবেন।
সুরা আন-নিসার ১৭৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন :
فَاَمَّا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا بِاللّٰهِ وَ اعْتَصَمُوْا بِهٖ فَسَیُدْخِلُهُمْ فِیْ رَحْمَةٍ مِّنْهُ وَ فَضْلٍ١ۙ وَّ یَهْدِیْهِمْ اِلَیْهِ صِرَاطًا مُّسْتَقِیْمًاؕ
এখন যারা আল্লাহর কথা মেনে নেবে এবং তার আশ্রয় খুঁজবে তাদেরকে আল্লাহ নিজের রহমত, করুণা ও অনুগ্রহের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে নেবেন এবং নিজের দিকে আসার সোজাপথ দেখিয়ে দেবেন।
আম্বিয়া (আ:) গন তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে লোকজনদেরকে সংঘবদ্ধ করে প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন –
شَرَعَ لَكُمْ مِّنَ الدِّیْنِ مَا وَصّٰى بِهٖ نُوْحًا وَّ الَّذِیْۤ اَوْحَیْنَاۤ اِلَیْكَ وَ مَا وَصَّیْنَا بِهٖۤ اِبْرٰهِیْمَ وَ مُوْسٰى وَ عِیْسٰۤى اَنْ اَقِیْمُوا الدِّیْنَ وَ لَا تَتَفَرَّقُوْا فِیْهِ١ؕ كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِیْنَ مَا تَدْعُوْهُمْ اِلَیْهِ١ؕ اَللّٰهُ یَجْتَبِیْۤ اِلَیْهِ مَنْ یَّشَآءُ وَ یَهْدِیْۤ اِلَیْهِ مَنْ یُّنِیْبُ
তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের সেই সব নিয়ম-কানুন নির্ধারিত করেছেন; যার নির্দেশ তিনি নূহকে দিয়েছিলেন এবং (হে মুহাম্মাদ) যা এখন আমি তোমার কাছে অহীর মাধ্যমে পাঠিয়েছি। আর যার আদেশ দিয়েছিলাম আমি ইবরাহীম (আ), মূসা (আ) ও ঈসাকে (আ) । তার সাথে তাগিদ করেছিলাম এই বলে যে, এ দ্বীনকে কায়েম করো এবং এ ব্যাপারে পরস্পর ভিন্ন হয়ো না। (হে মুহাম্মাদ) এই কথাটিই এসব মুশরিকের কাছে অত্যন্ত অপছন্দনীয় যার দিকে তুমি তাদে আহ্বান জানাচ্ছো। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা আপন করে নেন এবং তিনি তাদেরকেই নিজের কাছে আসার পথ দেখান, যারা তাঁর প্রতি রুজু করে।
(আশ-শূরা, আয়াত: ১৩)
ইসলামী সংগঠনের বৈশিষ্ট্য :
ইসলামী সংগঠনের প্রধান লক্ষ্য হবে আল্লাহর দেওয়া বিধানের আলোকে সমাজ গঠন করার মাধ্যমে আল্লাহকে রাজি খুশি করা।
একটি সুন্দর সাংগঠনিক কাঠামো থাকবে এবং যোগ্য নেতৃত্বের অধীনে সংগঠন পরিচালিত হবে।
সুশৃঙ্খল কর্মী বাহিনী থাকবে, যারা সকল কিছু উপরে দ্বীনি কাজকে প্রায়োরিটি দিবে। প্রয়োজনে জীবন বাজি রেখে আন্তরিকতার সাথে কাজ করে যাবে।
সাংগঠনিক শৃঙ্খলা বজায় রাখাতে কর্মীদের মধ্যে নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য থাকাবে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সদস্যদের মধ্যে পরামর্শ করে সংগঠন পরিচালনা করবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
ইসলামী সংগঠন একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি ও কর্মনীতি অনুসরণ করবে, যা সাংগঠনিক কার্যক্রমকে সুসংহত করবে।
জনশক্তিদেরকে দ্বীনি ও আধুনিক জ্ঞান এবং সাংগঠনিক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণমুলক কর্মসূচি রাখা।
�সকল পরিস্থিতিতে আল্লাহর উপর ভরসা রাখবে এবং রাসূল (সা.)-কে আদর্শ নেতা হিসেবে মানবে।
দায়িত্বশীল সর্বদা সংগঠনের মৌলিক নীতিমালা সংরক্ষণে সচেষ্ট থাকবে।
এবং দায়িত্বশীল নির্বাচিত হবে জনশক্তির মতামতের ভিত্তিতে।
মজবুত সংগঠন :
আদর্শের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া প্রতিটি সংগঠনের মূল কাজ হচ্ছে- সমাজের প্রচলিত নিয়ম নীতি আমূল পরিবর্তন করে যে আদর্শকে সামনে রেখে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছে তা সমাজে প্রতিষ্ঠা করা। সমাজের প্রতিষ্ঠিত শক্তির বিপরীতে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করা এতটা সহজ নয়,তার জন্য প্রয়োজন সংগঠনের মজবুতি। আমি সংক্ষেপে একটি মজবুত সংগঠনের নমুনা তুলে ধরছি।
ক. যোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব:
একটি সংগঠনের কর্মতৎপরতা নির্ভর করে তার নেতৃত্বের উপর। সংগঠনের কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যন্ত সকল জায়গায় যোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব থাকলে যে কোন কর্মসূচি সহজে বাস্তবায়ন করা যায়। বলিষ্ঠ বলতে শক্তিশালী সুঠাম দেহের অধিকারী এমন নয়। ইসলামী আন্দোলনের যোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব হচ্ছে -ঈমানদার ও ন্যায়পরায়ণ, জ্ঞান ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন, শারীরিকভাবে শক্তিশালী (তবে এটা জরুরী নয়) ও মানসিকভাবে দৃঢ়, দায়িত্বের প্রতি যত্নশীল ও আমানতদার, জনগণের কল্যাণে নিবেদিত প্রান, অহংকারী নয় বরং বিনয়ী, জবাবদিহিতার অনুভূতি সম্পন্ন। অনেকে শারীরিক শক্তি ও সম্পদকে যোগ্যতা মনে করেন। ইসলামি সংগঠনে সম্পদ ও প্রভাব প্রতিপত্তির চাইতে জ্ঞান ও হিকমাহকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
সুরা আল-বাক্বারাহর ২৪৭ আয়াতে আল্লাহ বলেন :
وَ قَالَ لَهُمْ نَبِیُّهُمْ اِنَّ اللّٰهَ قَدْ بَعَثَ لَكُمْ طَالُوْتَ مَلِكًا١ؕ قَالُوْۤا اَنّٰى یَكُوْنُ لَهُ الْمُلْكُ عَلَیْنَا وَ نَحْنُ اَحَقُّ بِالْمُلْكِ مِنْهُ وَ لَمْ یُؤْتَ سَعَةً مِّنَ الْمَالِ١ؕ قَالَ اِنَّ اللّٰهَ اصْطَفٰىهُ عَلَیْكُمْ وَ زَادَهٗ بَسْطَةً فِی الْعِلْمِ وَ الْجِسْمِ١ؕ وَ اللّٰهُ یُؤْتِیْ مُلْكَهٗ مَنْ یَّشَآءُ١ؕ وَ اللّٰهُ وَاسِعٌ عَلِیْمٌ
তাদের নবী তাদেরকে বললোঃ আল্লাহ তোমাদের জন্য তালুতকে বাদশাহ বানিয়ে দিয়েছেন। একথা শুনে তারা বললো- “সে কেমন করে আমাদের ওপর বাদশাহ হবার অধিকার লাভ করলো? তার তুলনায় বাদশাহী লাভের অধিকার আমাদের অনেক বেশি। সে তো কোন বড় সম্পদশালী লোকও নয়।” নবী জবাব দিল- “আল্লাহ্ তোমাদের মোকাবিলায় তাকেই নবী মনোনীত করেছেন এবং তাকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক উভয় ধরনের যোগ্যতা ব্যাপকহারে দান করেছেন। আর আল্লাহ তাঁর রাজ্য যাকে ইচ্ছা দান করার ইখতিয়ার রাখেন। আল্লাহ অত্যন্ত ব্যাপকতার অধিকারী এবং সবকিছুই তাঁর জ্ঞান-সীমার মধ্যে রয়েছে।”
সংগঠন মজবুতির প্রধান শর্ত যোগ্য নেতৃত্ব।
খ. জনশক্তি বৃদ্ধি ও সংগঠন সম্প্রসারণ :
কোনো সংগঠনের মজবুতি ও কার্যকর গতিশীলতার জন্য নিয়মিত নতুন সদস্যদের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত জরুরি। যখন সমাজের বৃহৎ অংশ সংগঠনের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে, তখন আদর্শভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ অনেক সহজ হয়ে যায়।
তাই জনশক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন নতুন এলাকায় সংগঠন সম্প্রসারণের লক্ষ্যে একটি সুপরিকল্পিত রোডম্যাপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। লক্ষ্যহীন সম্প্রসারণ কোনো সংগঠনের জন্য দীর্ঘস্থায়ী শক্তি নয়, বরং কখনো কখনো তা দুর্বলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
গ.দক্ষ ও যোগ্য দায়িত্বশীল দিয়ে সেক্রেটারীয়েট গঠন:
সংগঠনের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য কেবল মূল নেতৃত্বই নয়, বরং বিভিন্ন বিভাগীয় দায়িত্ব পালনের জন্য দক্ষ ও যোগ্য জনবল গঠন অপরিহার্য।
সংগঠনের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষা, জনশক্তির মানোন্নয়ন, সম্প্রসারণ, মতভেদ-সম্পর্কিত ব্যবস্থাপনা, এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সংগঠনকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করার জন্য একটি সুসংগঠিত ও দক্ষ সেক্রেটারিয়েট গঠন করা আবশ্যক।
ঘ. প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ব্যবহার:
একটি মজবুত ও কার্যকর সংগঠনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো—সংগঠনের জনশক্তির মানোন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকা। এ উপকরণগুলো হতে হবে আদর্শিক ও আধুনিক। যেমন: যুগোপযোগী বই-পুস্তক, যোগাযোগের জন্য কার্যকর মাধ্যম ও যানবাহন, নিজস্ব প্রচারমাধ্যম অথবা দক্ষ প্রচার কর্মী।
তাছাড়া, আধুনিক যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য সংগঠনের নিজস্ব পরিকল্পিত উপকরণ ও প্রস্তুতি থাকা অত্যন্ত জরুরি। এসব উপকরণের সঠিক সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ব্যবহারের মাধ্যমে সংগঠন তার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারে সুচারুভাবে।
ঙ.গন- মানুষের সংগঠনে রুপান্তরিত করা চেষ্টা :
একটি সংগঠনের শক্তি ও সফলতা নির্ভর করে তার গ্রহণযোগ্যতা ও ব্যাপ্তির উপর। শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি বা এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে সংগঠন কখনোই গণমানুষের সংগঠনে পরিণত হতে পারে না। তাই প্রয়োজন—সংগঠনকে প্রতিটি অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়া, যেন সমাজের প্রতিটি স্তরে এর প্রভাব ও উপস্থিতি দৃশ্যমান হয়।
সংগঠনের আদর্শ, দর্শন এবং উদ্দেশ্য সমূহ গণমানুষের মাঝে পৌঁছানোর জন্য প্রতিটি এলাকা, গ্রাম, মহল্লা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে সংগঠনের প্রতিনিধি থাকা আবশ্যক। আদর্শের আলো সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হলে শিকড় পর্যন্ত সংগঠনের বিস্তৃতি ঘটাতে হবে। এভাবে তৃণমূল পর্যন্ত সংগঠনের কার্যক্রম ছড়িয়ে দিলে সাধারণ জনগণ সংগঠনের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত মনে করবে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতে অংশগ্রহণ করবে।
গণমানুষের প্রকৃত সংগঠন হিসেবে গড়ে উঠতে চাইলে সংগঠনকে তাদের জীবনের বাস্তব সমস্যা ও সংকটগুলোর সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। জনসাধারণের ন্যায়সঙ্গত দাবি-দাওয়ার প্রতি দায়িত্বশীল অবস্থান গ্রহণ করতে হবে এবং কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর অন্যায় আধিপত্যের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। এই লড়াই কেবল শহরে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না—
রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামের মাটিতেও সংগঠনের কার্যকর নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে।
চ.নেতৃত্ব ও কর্মীদের হৃদ্রতা ও সৌহার্দ্যপূর্ন সম্পর্ক:
একটি সংগঠনের স্থায়িত্ব ও সাফল্যের অন্যতম প্রধান ভিত্তি হলো—নেতৃত্ব ও কর্মীদের মধ্যে আন্তরিক, সম্মানপূর্ণ ও ঈমানভিত্তিক সম্পর্ক। যদি কোনো সংগঠনের নেতৃত্ব নিজেকে ‘বস’ মনে করে এবং কর্মীদেরকে ‘ভৃত্য’ বা কেবল আদেশ পালনের যন্ত্র হিসেবে মনে করে, তাহলে সেই সংগঠনের ভিত্তিই দুর্বল থেকে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে কোনো কর্মী হয়তো দুনিয়াবি স্বার্থে বাহ্যিক আনুগত্য প্রদর্শন করতে পারে, কিন্তু তার হৃদয়ের গভীরে নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে যাবে, এবং ধীরে ধীরে অসন্তোষ, বিরাগ বা বিদ্বেষ বাসা বাঁধবে—যা একটি সুসংগঠিত কাঠামোর জন্য চরম হুমকি।
অন্যদিকে, সেই সংগঠনই প্রকৃত মজবুত সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠে—যেখানে নেতৃত্ব কর্মীদের ভাইয়ের মতো ভালোবাসে, সম্মান করে, এবং সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়ায়। এই মানবিক সম্পর্ক কর্মীদের হৃদয়ে নেতৃত্বের জন্য ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও আস্থা সৃষ্টি করে। তখন তারা কেবল আদেশ পালনের মানসিকতা নিয়ে কাজ করে না—বরং নেতৃত্বের প্রতিটি নির্দেশকে দায়িত্ব ও সম্মানের বিষয় মনে করে। এমনকি বড় ঝুঁকি ও ত্যাগের ক্ষেত্রেও তারা সাহসিকতার সাথে নেতৃত্বের পাশে দাঁড়ায়।
এ ধরনের কর্মীরা কখনোই ভাড়াটে কর্মীর মতো আচরণ করে না। বরং সংগঠনের লক্ষ্য ও স্বপ্নকে তারা নিজের স্বপ্ন হিসেবে গ্রহণ করে। সংগঠনের প্রত্যেকটি কাজকে তারা আত্মার দায়িত্ব হিসেবে পালন করে এবং সর্বোচ্চ নিষ্ঠা, দক্ষতা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকে। সুতরাং, নেতৃত্ব ও কর্মীদের মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক শুধু একটি আদর্শিক সংগঠনের সৌন্দর্যই নয়, বরং সাংগঠনিক দৃঢ়তার এক অপরিহার্য উপাদান।
ছ. কর্মীদের পারস্পরিক সুসম্পর্ক:-
শুধু সংখ্যার আধারে সংগঠনের মজবুতি নির্ধারিত হয় না। শত সহস্র কর্মী থাকলেও যদি তাদের মধ্যে আন্তরিকতা, সৌহার্দ্য ও সহযোগিতার মনোভাব না থাকে, তবে সেই সংগঠন ভেতরে ভেতরে দুর্বলই থেকে যায়। প্রকৃত মজবুত সংগঠন সেই, যেখানে কর্মীদের মধ্যে থাকে গভীর পারস্পরিক সুসম্পর্ক—ভ্রাতৃত্ববোধ, সহানুভূতি এবং একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচরণ।
যেখানে এক কর্মী অপরের সুখে হাসে, দুঃখে পাশে দাঁড়ায়, নিজের প্রয়োজনকে পাশে সরিয়ে রেখে অন্যের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দেয়—সেই সংগঠনের শক্তি অদ্বিতীয়। এই ধরনের সম্পর্ক কেবল দায়িত্ব পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং আত্মিক বন্ধনে রূপ নেয়, যা সংগঠনের অভ্যন্তরীণ সংহতিকে সুদৃঢ় করে তোলে।
এমন সম্পর্কের মাঝে হিংসা, বিদ্বেষ, পরনিন্দা কিংবা বিভাজনের কোনো স্থান থাকে না। বরং সেখানে গড়ে ওঠে একটি সুস্থ ও ইতিবাচক সাংগঠনিক পরিবেশ—যা সংগঠনের অগ্রগতি ও টেকসই সাফল্যের অন্যতম পূর্বশর্ত।
সংগঠনের কর্মীদের মাঝে পারস্পরিক সুসম্পর্কের উপস্থিতি শুধু একটি নৈতিক সৌন্দর্য নয়, বরং এটি সাংগঠনিক মজবুতির এক অনন্য বৈশিষ্ট্য—যা যে কোনো আদর্শিক ও কার্যকর সংগঠনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য।
জ. পরিকল্পিত ও ভারসাম্যপূর্ণ পদক্ষেপ:
একটি সংগঠনের প্রকৃত শক্তি তার সুপরিকল্পিত ও ভারসাম্যপূর্ণ কর্মতৎপরতার মধ্যেই নিহিত। বিশেষ করে একটি আদর্শিক সংগঠন কখনো একমাত্রিক পথে চলতে পারে না; বরং তাকে বহুমুখী ও বহুমাত্রিক কর্মসূচি নিয়ে এগোতে হয়—চিন্তা-চেতনার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি থেকে শুরু করে, ব্যক্তিত্বের গঠনে আমূল পরিবর্তন, সামাজিক ব্যাধি ও দুর্বৃত্তপনার বিরুদ্ধে সংস্কারমুখী কার্যক্রম পরিচালনা, এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্বে সৎ ও যোগ্য মানুষের উত্থানের পরিবেশ সৃষ্টি—এসবই একটি বাস্তবধর্মী সংগঠনের কাজের পরিধির অন্তর্ভুক্ত।
এই কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নে সংগঠন নানা রকম কার্যক্রম চালায়। প্রতিটি কাজই অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, অর্থবহ এবং পরস্পর সম্পর্কিত। এগুলোর কোনো একটিকে উপেক্ষা করা যেমন সংগঠনের সামগ্রিক ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে, তেমনি একটি মাত্র দিককে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিলে দৃষ্টিভঙ্গির একচোখেমি তৈরি হয়, যার পরিণতিতে সংগঠনের গতিধারা বিচ্যুত হতে পারে।
তাই প্রয়োজন—সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রতিটি কর্মসূচিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে, সমন্বিতভাবে বাস্তবায়ন করা। মাঠপর্যায়ের কর্মীরা যেন কোনো একটি কাজেই একপেশে হয়ে না পড়ে—সে বিষয়ে দায়িত্বশীলভাবে দিকনির্দেশনা দিতে হবে সংগঠনের নেতৃত্বকে।
যদি সংগঠন তার নানাবিধ কর্মতৎপরতায় ভারসাম্য ও পরিকল্পনার সৌন্দর্য বজায় রাখতে পারে, তাহলে তাকে নিঃসন্দেহে একটি মজবুত, সুসংগঠিত ও ভবিষ্যতমুখী সংগঠন হিসেবে মূল্যায়ন করা যায়।
ঝ.সমৃদ্ধ বায়তুল ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা:
একটি সংগঠনের কার্যক্রম যতই মহৎ হোক না কেন, তার বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন হয় পর্যাপ্ত আর্থিক শক্তির। সংগঠনের বহুমাত্রিক কর্মতৎপরতা.প্রচার, প্রশিক্ষণ, সংগঠনের সম্প্রসারণ কিংবা সমাজ সংস্কারমূলক উদ্যোগ.সবকিছুর পেছনেই থাকে অর্থের মৌলিক ভূমিকা। আর্থিক সংকটে যদি কোনো কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত হয়, তা শুধু দুর্ভাগ্যজনক নয়—বরং তা সংগঠনের অন্তর্নিহিত দুর্বলতাকেও নগ্নভাবে প্রকাশ করে।
এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হলে সংগঠনের অর্থভিত্তি অর্থাৎ বায়তুল মাল—কে শক্তিশালী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তুলতে হবে। সংগঠনের অর্থের যোগান কেবল কেন্দ্রীয় কোনো উদ্যোগ বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক অনুদানের উপর নির্ভরশীল থাকলে চলবে না; বরং গোটা কর্মীবাহিনীকে নিজ দায়িত্ববোধ থেকে নিয়মিতভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে এই তহবিল গঠনের কাজে। এর জন্য প্রয়োজন—সদস্যদের অন্তরে সংগঠনের প্রয়োজন ও দায়িত্ববোধকে জাগ্রত করা, নিরবচ্ছিন্ন অনুপ্রেরণা প্রদান এবং অর্থ-আহ্বানে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মানসিকতা গড়ে তোলা। তবে শুধু অভ্যন্তরীণ কর্মীবাহিনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। সংগঠনের প্রভাব বলয়ের অন্তর্গত সম্ভাবনাময় ও হৃদয়বান ব্যক্তিদের মাঝে এর প্রয়োজনীয়তা, মহত্ব ও মর্যাদা হৃদয়গ্রাহীভাবে তুলে ধরতে পারলে, তারাও এই আদর্শিক তহবিলে উদারভাবে দান করতে অনুপ্রাণিত হবেন।
ঞ. নৈতিক আদর্শে প্রভাব বিস্তার:
একটি আদর্শিক সংগঠনের প্রকৃত সাফল্য নির্ধারিত হয় তার নৈতিক ভিত্তি, মানবিক কর্মধারা এবং জনমানসে গড়ে ওঠা আস্থার উপর। সংগঠন যেই ভূখণ্ডে বা অঞ্চলে কাজ করে, সেখানে এর নেতৃত্ব ও কর্মীবাহিনীর সুদূরপ্রসারী প্রভাব থাকা অপরিহার্য। তবে এই প্রভাব আকস্মিকভাবে কিংবা প্রচারনির্ভরভাবে গড়ে উঠে না। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘস্থায়ী, বহুমাত্রিক ও জনবান্ধব কর্মতৎপরতার ধারাবাহিকতা।
সংগঠন যখন সৎ উদ্দেশ্য, মানবিক বোধ ও নৈতিক অনুশীলনের মাধ্যমে জনগণের হৃদয়ে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়, তখনই ধীরে ধীরে সমাজে একটি বিশ্বাসভিত্তিক প্রভাব বিস্তার লাভ করে। আসলে সমাজের প্রতিটি মানুষ-ই কল্যাণের কাঙ্গাল। তারা চায় এমন একটি আশ্রয়, যে আশ্রয়ে মিলবে সহমর্মিতা, সমাধান এবং ভালোবাসা। যখন তারা অনুভব করে যে এই সংগঠন এবং এর কর্মীবাহিনী নিঃস্বার্থভাবে তাদের কল্যাণের জন্য নিবেদিত, তখন তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
এমন অবস্থায় সাধারণ মানুষ তাদের জীবনের সংকট, দুঃখ, দুর্দশা, সামাজিক জটিলতা—সবকিছু নিয়ে ছুটে আসে সংগঠনের মানুষের কাছে। তারা আশা করে—এখানেই মিলবে সমাধান, আশ্বাস ও সাহচর্য। যদি সংগঠন এই বিশ্বাসের প্রতিদান দিতে পারে অর্থবহ সহায়তা, আন্তরিক পরামর্শ বা বাস্তবিক সহযোগিতার মাধ্যমে, তবে সেই মানুষগুলো কাগজে-কলমে সদস্য না হলেও অন্তরের গভীরে এই সংগঠনের আপন মানুষে পরিণত হয়।
যখন কোনো কর্ম এলাকায় এমন একটি আবহ গড়ে ওঠে—যেখানে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংগঠনের প্রতি আস্থাশীল, হৃদয় দিয়ে সম্পর্কযুক্ত এবং কার্যত অংশীদার—তখন নিঃসন্দেহে বলা যায়, সংগঠন একটি শক্তিশালী, জনভিত্তিক এবং নৈতিকভাবে প্রভাবশালী কাঠামো নির্মাণে সফল হয়েছে। এটি সংগঠনের মজবুত ভিত্তির অন্যতম সুদৃঢ় স্তম্ভ।
ট. শত্রুপক্ষের অপকৌশল মোকাবেলার সক্ষমতা অর্জন
ইসলামী সংগঠনের উপস্থাপিত আদর্শ এতটাই পরিপূর্ণ ও সর্বোত্তম যে, বৈরী শক্তিগুলোর পক্ষেও এর বিপক্ষে বাস্তব কোনো যুক্তি তুলে ধরা সম্ভব নয়। প্রতিটি যুক্তি ও বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয়ে যায়, ইসলামই একমাত্র পরিপূর্ণ ও কল্যাণময় জীবনব্যবস্থা। কিন্তু যারা এর সৌন্দর্য, মানবিকতা ও কল্যাণমূলক দিক উপলব্ধি করতে অক্ষম, তারাই একান্তই বিদ্বেষপ্রসূত কারণে এর বিরুদ্ধাচরণে নেমে পড়ে।
আদর্শিক মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে তারা ষড়যন্ত্রের পথে হাঁটে। বিভ্রান্তিকর মিথ্যাচার, অপপ্রচার আর আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে সংগঠনের কর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে চায়। উদ্দেশ্য একটাই—মানুষকে ইসলামী আন্দোলনের সত্যতা ও গাম্ভীর্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখা।
এই চক্রান্তজাল ছিন্ন করেই ইসলামী সংগঠনকে এগিয়ে যেতে হবে। জনগণের অন্তরে সত্য ও ন্যায়ের বাণী পৌঁছে দিতে হবে নিরলসভাবে। যাতে করে কোনো মিথ্যা প্রচারণা কিংবা বিভ্রান্তিমূলক তৎপরতা তাদের চেতনা কলুষিত করতে না পারে।এর জন্য প্রয়োজন—ব্যাপক গণসংযোগ, চিন্তাশীল ও হৃদয়গ্রাহী দাওয়াত পত্র ও প্রকাশনা ও সংবাদপত্র প্রকাশ এবং গঠনমূলক জনমত গঠনের ধারাবাহিক উদ্যোগ।
সারকথা, বৈরী শক্তিগুলোর সমস্ত অপকৌশল ব্যর্থ করে দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্তিমুক্ত রাখা এবং জনগণের সঙ্গে ইসলামী সংগঠনের একটি দৃঢ় ও বিশ্বাসনির্ভর সম্পর্ক স্থাপন ও রক্ষা করাই এ পর্যায়ে সংগঠনের মূল দায়িত্ব। সংগঠন যদি এই কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পারে, তবে নিঃসন্দেহে বলা যাবে—সংগঠন মজবুতির এক অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূরণে সফল হয়েছে।
সংগঠক ও দায়িত্বশীল:
সংগঠক (Organizer) হলেন সেই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি, যিনি একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের লক্ষ্যে গভীর চিন্তা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি কেবল পরিকল্পনাই করেন না, বরং সেই পরিকল্পনার আলোকে কার্যসম্পাদন, দিকনির্দেশনা ও সমন্বয়ের গুরুদায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নেন।
একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা, তা পরিচালনা এবং সদস্যদের মাঝে ঐক্য ও সহযোগিতার পরিবেশ গড়ে তোলা—এসবই একাধারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কষ্টসাধ্য ও ধৈর্যনির্ভর কাজ। এজন্য চাই প্রচণ্ড ধৈর্য (সবর), কঠোর পরিশ্রম, নিঃস্বার্থ ত্যাগ এবং সুদূরপ্রসারী বুদ্ধিমত্তা।
প্রকৃত সংগঠককে সমাজে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়- যেমন:
মানুষের অবজ্ঞা ও বিদ্রূপ,
যোগ্য ও নিবেদিতপ্রাণ সহযোগী ও জনশক্তির অভাব,
আর্থিক সংকট,
এবং কায়েমি স্বার্থবাদীদের অপপ্রচার ও বাধা।
এই সব প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে, একজন স্বপ্নদ্রষ্টা সংগঠক নিজের লক্ষ্যপানে এগিয়ে যান। তিনি যেন হয়ে ওঠেন এক নিরন্তর যাত্রী—স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য পাগলের মতো ছুটে চলেন, পেরেশানি ও প্রতিকূলতাকে সঙ্গী করে।
যিনি এই কঠিন যাত্রায় হাল ছাড়েন না, বরং আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল,সততা ও আত্মত্যাগ নিয়ে এগিয়ে যান—তিনিই হলেন একজন প্রকৃত সংগঠক।
দায়িত্বশীল (Responsible person) হলেন সেই ব্যক্তি যিনি তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য আন্তরিকতা, সততা ও সচেতনতার সাথে পালন করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, এবং প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে।”
— সহীহ বুখারী ও মুসলিম
হাদিসের আলোকে প্রত্যেক মানুষ তার অবস্থান, সামর্থ্য ও ক্ষমতার আলোকে দায়িত্বশীল।
ইমাম বা শাসক -জনগণের উপর, স্বামী -পরিবারের উপর, স্ত্রী -স্বামীর ঘরের ও সন্তানদের উপর, কর্মচারী- তার কর্তার সম্পদের উপর,শিক্ষক/মালিক-অধীনস্থদের জন্য দায়িত্বশীল।
সংগঠক ও দায়িত্বশীলের কাজের ধরণ আলাদা হলেও দুজনেই গুরুত্বপূর্ণ। সংগঠক ছাড়া সংগঠন তৈরী/সম্প্রসারণ হয় না। আর দায়িত্বশীল ছাড়া সংগঠনের কার্যস্পন্ন হয়না।
সংগঠকের কার্যক্রম :
সংগঠক হচ্ছেন স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যের রাস্তা তৈরী করার পরিকল্পনাবিদ ও শ্রমিক । যে রাস্তা দিয়ে চলাচল করা প্রতিটি মানুষ নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে স্বচ্ছন্দে। সে জন্যে সংগঠককে যে কাজ গুলো করা প্রয়োজন তা হচ্ছে –
১. সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করে মানুষকে সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানানো।”
২.সম্পৃক্ত জনগোষ্ঠীকে আদর্শিক প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে দায়িত্ব বণ্টন করে একটি শক্তিশালী টীম গঠন করা।
রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন :যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমদের দায়িত্ব গ্রহণ করল, অথচ কারো থেকে ভালো কাউকে থাকা সত্ত্বেও তাকে দায়িত্ব দিল না, সে নিশ্চয়ই আল্লাহর সঙ্গে খিয়ানত করল।— (আবু দাউদ)
৩.সাংগঠনিক কার্যক্রমে এক্টিভ ও সিরিয়াস সদস্যদের নিয়ে একটি শূরা (পরামর্শমূলক) টীম গঠন করা।”
সুরা আশ-শূরার ৩৮,৩৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন :
وَ الَّذِیْنَ اسْتَجَابُوْا لِرَبِّهِمْ وَ اَقَامُوا الصَّلٰوةَ١۪ وَ اَمْرُهُمْ شُوْرٰى بَیْنَهُمْ١۪ وَ مِمَّا رَزَقْنٰهُمْ یُنْفِقُوْنَۚ-
وَ الَّذِیْنَ اِذَاۤ اَصَابَهُمُ الْبَغْیُ هُمْ یَنْتَصِرُوْنَ
যারা তাদের রবের নির্দেশ মেনে চলে, নামায কায়েম করে এবং নিজেদের সব কাজ পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে চালায়, আমি তাদের যা রিযিক দিয়েছি তা থেকে খরচ করে.এবং তাদের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করা হলে তার মোকাবিলা করে।
৪.সংগঠন পরিচালনার জন্য একটি স্থায়ী কর্মনীতি ও বাস্তবমুখী কর্মসূচি নির্ধারণ করা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন
اِنَّ اللّٰهَ بَالِغُ اَمْرِهٖ١ؕ قَدْ جَعَلَ اللّٰهُ لِكُلِّ شَیْءٍ قَدْرًا
আল্লাহ প্রত্যেক কাজের জন্য একটি সময় নির্ধারণ করেছেন।— [সূরা আত্তালাক, ৬৫:৩]
সুসংহত ও পূর্বপরিকল্পিত কর্মপন্থা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী কাজকে সুষ্ঠু ও ফলপ্রসূ করে।
৫. সাংগঠনিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে সংগঠক তার পরবর্তী একঝাঁক সুদক্ষ দায়িত্বশীল তৈরী করা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায়।
চলবে —–
বই- দাঈ ও সংগঠক- লেখক :আবু নাঈম মু শহীদুল্লাহ্