পৃথিবীর ইতিহাসে যে কয়েকটি জাতিকে আল্লাহ ধ্বংস করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো কওমে নূহ, ‘আদ, ছামূদ, কওমে লূত, মাদইয়ান ও কওমে ফেরাঊন। অবশ্য কুরআনে কওমে ইবরাহীমের কথাও উল্লেখ আছে। যদিও তারা একসাথে ধ্বংস হয়নি। এই পর্বে আমি কওমে নূহ (আঃ)-এর প্রসঙ্গ সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করব।
আল্লাহর অবাধ্যতা ও নানান অপকর্মে লিপ্ত জাতিকে নূহ (আঃ) দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্নভাবে দাওয়াত দিলেও তারা তাঁর সঙ্গী হয়নি। হাতে গোনা অল্প কয়েকজন ঈমান এনেছিলেন, সংখ্যায় তারা ছিল খুবই কম। স্বয়ং তাঁর চার পুত্র—সাম, হাম, ইয়াফিছ এবং ইয়াম (বা কেন‘আন)। প্রথম তিনজন ঈমান আনলেও চতুর্থজন কাফের ছিল। ফলে তুফানে সে ডুবে মারা যায়।
তুফানে নুহ বা নূহ (আঃ) প্লাবনের কয়েকটি কারণ আমি তুলে ধরছি –
১.শিরক করা ও মূর্তিপূজা চালু করা-
সূরা নূহ: ২৩নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
তারা বলেছে, তোমরা নিজেদের দেব-দেবীদের কোন অবস্থায় পরিত্যাগ করো না। আর ওয়াদ, সুওয়া’আ, ইয়াগুস, ইয়াউক এবং নাসরকেও পরিত্যাগ করো না।
২.তাওহীদকে অস্বীকার করা
সূরা আনকাবূতের ১৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন –
আমি নূহকে তাদের সম্প্রদায়ের কাছে পাঠাই এবং সে তাদের মধ্যে থাকে পঞ্চাশ কম এক হাজার বছর। শেষ পর্যন্ত তুফান তাদেরকে ঘিরে ফেলে এমন অবস্থায় যখন তারা জালেম ছিল।
৩. নবীর আহ্বান প্রত্যাখ্যান ও বিদ্রূপ করা-
তারা বলত, “আমরা তোমাকে মানুষের মতোই একজন মানুষ ছাড়া আর কিছু মনে করি না। (সূরা হূদ: ২৭)
৪. সম্পদ ও ক্ষমতার অহংকারে সত্যকে অস্বীকার করতো-
তারা গরীব মুমিনদের অবজ্ঞা করত এবং তাদের সাথে বসতে অস্বীকার করত। (সূরা হূদ: ২৯)
৫. কুফরী ও অবাধ্যতায় অটল থাকতো-
হযরতে নূহ আঃ যতভাবেই দাওয়াত দিত তারা বলত: তুমি যাই আনো না কেন, আমরা তা কখনো মানব না।(সূরা হূদ: ৩২)
৬. প্রকাশ্যে পাপাচার করা
তারা শুধু শিরকেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং প্রকাশ্যে পাপাচারে লিপ্ত ছিল। (সূরা নূহ: ২১)
৭. সন্তানদেরকে কুফরী শিক্ষা দিতো-
তারা তাদের সন্তানদের বলত যেন আল্লাহর একত্ববাদ গ্রহণ না করে এবং পূর্বপুরুষের মূর্তিগুলো আঁকড়ে ধরে।
(সূরা নূহ: ২৩-২৪)
৮. নবী আঃ কে হত্যার হুমকি দিতো- তারা বলতো যদি থেমে না যাও তবে তোমাকে পাথর মারা হবে।”
(সূরা আশ-শু’আরা: ১১৬)
৯. আল্লাহর নির্দেশের কারনে যখন নূহ আঃ জাহাজ বানাচ্ছিলেন, তখন তারা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করত।
তারা শুধু অবাধ্যই ছিল না, বরং ব্যাপকভাবে সমাজে জুলুম ও ফাসাদ ছড়িয়ে দিয়েছিল।
যার ফলে আল্লাহ তাদেরকে প্লাবন দিয়ে শেষ করে দিয়েছেন।
আল্লাহর এ শাস্তি থেকে অল্পসংখ্যক মানুষ (প্রায় ৭০–৮০ জন) যারা ঈমান এনেছিল, তারা নূহ (আঃ)-এর জাহাজে উঠে রক্ষা পায়। আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী প্রতিটি প্রাণীর এক জোড়া করে জাহাজে তোলা হয়েছিল—
গরু, ভেড়া/ছাগল, ঘোড়া, উট, গাধা, হরিণ, সিংহ, বাঘ, নেকড়ে, পাখি, মুরগি, কবুতর, সাপ, ইঁদুরসহ নানা ছোট প্রাণী।তাদের খাদ্যের জন্য পর্যাপ্ত শস্য, ফল, খেজুর, মধু ও শুকনো খাবারও রাখা হয়েছিল।
প্রায় ছয় মাস স্থায়ী এ প্লাবনে পৃথিবীর সব কিছু ডুবে যায়। কেবল কাঠ ও লোহার তৈরি জাহাজটি ভেসে থাকে। প্লাবন শেষে আল্লাহর বান্দারা নতুনভাবে পৃথিবীতে বসবাস শুরু করে। নূহ (আঃ)-এর তিন পুত্রের বংশধারা থেকেই মানব জাতি বিস্তার লাভ করে—
সাম আরব অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে, হাম হাবশায় (ইথিওপিয়া),ইয়াফিছ গ্রিক অঞ্চলে।
তাই সামকে বলা হয় আরবদের পিতা, হামকে হাবশাদের পিতা, এবং ইয়াফিছকে রোমক/গ্রিকদের পিতা।
অতএব, প্লাবন-পরবর্তী মানবজাতি সবাই নূহ (আঃ)-এর বংশধর।
সামের বংশধরদের মধ্যেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন মহান নবীগণ—হযরত ইবরাহীম (আঃ), তাঁর দুই পুত্র ইসমাঈল (আঃ) ও ইসহাক (আঃ)। ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধরদের মধ্য থেকে মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ, শেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সা:) দুনিয়ায় আগমন করেন।
অন্যদিকে, ইসহাক (আঃ)-এর বংশধরদের মধ্যেই ছিলেন অসংখ্য মহান নবী ও রাসূল—যেমন হযরত ইয়াকূব (আঃ), ইউসুফ (আঃ), মূসা (আঃ), দাঊদ (আঃ), সুলায়মান (আঃ), ইউনুস (আঃ), ইলিয়াস (আঃ), ঈসা (আঃ) প্রমুখ আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ।
কিন্তু হাম ও ইয়াফেছ-এর বংশধরদের মধ্যে আল্লাহ প্রেরিত কোনো নবী বা রাসূলের নাম খুজে পাওয়া যায়নি।
সামের বংশধর : আরব সভ্যতার সূচনা
মানব ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকগুলোর মধ্যে একটি হলো মহাতুফান বা প্লাবনের ঘটনা। আল্লাহর নির্দেশে হযরত নূহ (আঃ)-এর নৌকায় যারা আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদের মাধ্যমেই নতুন মানবসভ্যতার সূচনা ঘটে। যা আমি আগেও উল্লেখ করেছি।
হযরত নূহ (আঃ)-এর পুত্র সাম-এর বংশধররা মূলত মধ্যপ্রাচ্যের উর্বর অঞ্চলগুলোতে বসতি স্থাপন করেছিলেন। যা বর্তমান ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, জর্ডান ও লেবানন।এ অঞ্চলে পরবর্তীতে অনেক নবী ও রাসূল প্রেরিত হয়েছিলেন। বিশেষ করে মক্কা-মদিনা অঞ্চল ইসমাঈল (আঃ)-এর মাধ্যমে সামের বংশধরদের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এখানেই আমারদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। আল্লাহর নবী ইসহাক (আঃ)-এর বংশধররা মূলত ফিলিস্তিন ও আশেপাশের শাম (সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান) অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন।
হযরতে ইয়াকুব (আঃ), ইউসুফ (আঃ), মূসা (আঃ) প্রমুখ নবীদের ইতিহাস যুক্ত এ অন্ঞ্চল। এবং এখানেই প্রাচীন সুমের, আক্কাদ ও বাবিল সভ্যতা বিকাশ লাভ করে।
সামের বংশধরগণ ইতিহাসে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন, কারণ তাদের মাধ্যমেই আরব অঞ্চলসহ মধ্যপ্রাচ্যে এক নবযাত্রা ও নতুন সভ্যতার সূচনা হয়েছিল।
সামের বংশধর ও নবুওতের ধারাবাহিকতা
সামের বংশধরদের মধ্যেই প্রেরিত হয়েছেন বহু নবী ও রাসূল। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম (আঃ) তার পুত্রদ্বয় ইসমাঈল (আঃ) ও ইসহাক (আঃ)-এর মাধ্যমে সামের বংশ বিস্তার লাভ করে।
হযরতে ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধরদের মধ্য থেকে জন্ম নিয়েছিলেন সমগ্র মানবজাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)। অপরদিকে, ইসহাক (আঃ)-এর বংশধরদের মধ্য থেকে জন্ম নিয়েছেন বহু নবী ও রাসূল যেমন হযরত ইয়াকূব (আঃ), ইউসুফ (আঃ), মূসা (আঃ), দাঊদ (আঃ), সুলায়মান (আঃ), ইউনুস (আঃ), ইলিয়াস (আঃ) এবং ঈসা (আঃ)। ফলে সামের বংশধররা হয়ে উঠেছিলেন নবুওতের ধারাবাহিকতার প্রধান বাহক।
হামের বংশধর : মিশরীয় সভ্যতার সূচনা
প্লাববের পর হযরতে নুহ আঃ সন্তান হাম ও তার বংশধররা আফ্রিকা, দক্ষিণ আরব, মিসর, কানা’আন ও আশপাশের এলাকায় বসতি স্থাপন করেন।
হাম এর সন্তান মিসরাইম মিসরীয়দের পূর্বপুরুষ বলা হয়। এখান থেকে ফেরাউনদের বংশ, প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা গড়ে ওঠে। হামের আরেক কানা’আন এর মাধ্যমে ফিলিস্তিন অন্ঞ্চলে বসতি গড়ে উঠে তাদেরকে কানা’আনীয় জেবুসীয়, আমোরীয় জাতি বলা হতো।
আফ্রিকার দক্ষিণ দিকে সুদান, নুবিয়া ও ইথিওপিয়া এলাকায় বসতি স্থাপন করেন হামের আরকে সন্তান কুশ। তাদেরকে কুশাইট বলা হতো এবং এই কুশাইট রা আফ্রিকার অন্যতম প্রাচীন জাতি।
উত্তর আফ্রিকার বারবার, লিবীয়, সোমালি প্রভৃতি জনগোষ্ঠীও হাম-এর বংশধর।
কুরআন বর্নিত আদ জাতি হামের বংশধরদের থেকেই জন্ম। এ বিষয়ে একটা ছোট্ট লেখা পরবর্তীতে সংযোজন করবো, ইনশাআল্লাহ।
ইয়াফেসের বংশধর :ইউরোপীয় সভ্যতা
প্লাবনের পর ইয়াফেসের বংশধররা প্রথমে তুর্কিস্তান ও ককেশাস অঞ্চল, যা বর্তমান মধ্য এশিয়া: উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও পূর্ব এশিয়ার চীন, মঙ্গোলিয়া, সাইবেরিয়া এবং ক্রমান্বয়ে ইউরোপের গ্রিক, রোমান, স্লাভ, জার্মানিক এলাকায় বসতি স্থাপন করেন।ইউরোপীয় জাতির আদি শিকড় ইয়াফেসের বংশে। সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল গ্রীক সভ্যতার উজ্জ্বল নক্ষত্র। গ্রীকদের পর রোমান সভ্যতা এদের মুল পিতা হযরত নুহ এর সন্তান ইয়াফেস। শুধু তাই না তুর্কী জাতি,মোঙ্গলীয় জাতি এবং চীনা জাতিরও পূর্ব পুরুষ ইয়াফেস।
চলবে—–
বই- রক্তে লেখা ইতিহাস – লেখক – আবু নাঈম মু শহীদুল্লাহ্