১৯শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
রাত ২:৫৭
১৯শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
রাত ২:৫৭

অবাধ্য আদ ও সামূদ জাতীর ধ্বংস, আমাদের জন্য শিক্ষা – আবু নাঈম মু শহীদুল্লাহ্

Share Option;

**অহংকার, অবাধ্যতা ও পাপাচার জাতিকে ধ্বংস করে আর বিনয়, আনুগত্য ও সততা বাচিয়ে রাখে শতাব্দীর পর শতাব্দী**

পৃথিবীর ইতিহাসে বহুল আলোচিত এক জাতি ছিল, যারা প্রভাবশালী, বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী ছিল। তাদের প্রতিটি মানুষ ছিল উচ্চদেহী ও বাহুবলী — মানবসমাজে যাদেরকে দৈত্যাকৃতির বলে পরিচিত করা হতো। তাদের স্থাপত্যশিল্প ও কারুকার্য আজও গবেষণার বিষয়।

তাদের কথা সংক্ষেপে তুলে ধরছি — হযরত নূহ (আঃ)-এর প্লাবনের পর তাঁর পুত্র সাম-এর বংশধরদের মধ্যে আদ ও সামূদ জাতি ছিল। তারা নতুন সভ্যতার সূচনায় তাওহীদে বিশ্বাসী ছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তারা ধীরে ধীরে আল্লাহর সাথে শিরক করা, অন্যায় ও জুলুমসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে।

আদ জাতি
ইয়েমেনের কাছাকাছি ‘আহকাফ’ নামক এলাকা বর্তমান দক্ষিণ আরব উপদ্বীপের ওমান, ইয়েমেন ও রুবুল খালি মরুভূমির সংযোগস্থলে অবস্থিত ছিল। সহজভাবে বলা যায়, এটি বর্তমান ধোফার ও হাজরামাউত অঞ্চলের মধ্যবর্তী এলাকা।

‘আহকাফ’ শব্দের অর্থ হলো বালিয়াড়ি বা বালুর পাহাড়, যা আদ জাতির বসবাসের অঞ্চলকে নির্দেশ করে। তাদের রাজধানীর নাম ছিল ইরাম। ধারণা করা হয়, ওমানের ধোফার প্রদেশে অবস্থিত বর্তমান উবার বা শিসর নামে পরিচিত স্থানের ধ্বংসাবশেষই ইরামের নিদর্শন।

হযরত নূহ (আঃ)-এর পুত্র সাম–এর প্রপৌত্র ছিলেন হযরত হুদ (আঃ)। তাওহীদে বিশ্বাসী সাম পুত্র আরফাখশাদ ও তাঁর পুত্র শালিহ (আঃ)-এর সময় থেকে আদ জাতি ধীরে ধীরে অহংকার, অবাধ্যতা, শিরক ও আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকারের চরমে পৌঁছে যায়। তাদের এসব কর্মকাণ্ডের কারণে তারা ‘আরবুল-বা’ইদাহ’ — অর্থাৎ ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন আরব — নামে পরিচিত হয়।

আদ জাতির বৈশিষ্ট্যঃ-
১.তারা ছিল অস্বাভাবিকভাবে লম্বা, শক্তিশালী ও দেহে বলবান (কুরআন: সূরা ফজর ৬-৮)।
২.বিশাল প্রাসাদ, স্তম্ভ, ও নগর (স্তম্ভসমৃদ্ধ ইরাম) নির্মাণে বিখ্যাত ছিল।
৩.তারা পাহাড় কেটে ঘর বানাত (সূরা আশ-শু‘আরা ১২৮-১২৯)।
৪.তারা ছিল কৃষি, বাণিজ্য ও সম্পদে সমৃদ্ধ — এক উন্নত নগর সভ্যতা।
৫.নিজেদের শক্তি ও ঐশ্বর্যের কারণে তারা বলত:আমাদের চেয়ে শক্তিশালী আর কে আছে? (সূরা ফুসসিলাত ৪১:১৫)
৬.দক্ষিণ আরবের অন্যান্য জাতিগুলির ওপর প্রভাব রাখত,

আদ জাতির অপরাধ ও অন্যায়সমূহঃ-
পবিত্র কুরআনে আদ জাতির যে সকল অন্যায় ও অপরাধ আলোচনা করা হয়েছে –

১.তারা মূর্তিপূজা করত ও আল্লাহর পরিবর্তে তাদের “বড় দেবতাদের” উপাসনা করত।(সূরা হূদ ৫০-৫১)

২.তারা বলত, “আমাদের চেয়ে শক্তিশালী কে আছে?” — নিজেদের শক্তিকে আল্লাহর উপরে তুলত।(সূরা ফুসসিলাত ১৫)

৩.তারা বলত, “তুমি পাগল, আমাদের পূর্বপুরুষদের কেউ এমন কথা বলেনি।(সূরা আল-আ‘রাফ ৬৬)
৪.তোমরা শক্তি প্রয়োগ করে মানুষের ওপর জুলুম করো।(সূরা আশ-শু‘আরা ১৩০)

৫.যে তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান দিয়েছে, তাকে ভয় করো— কিন্তু তারা কৃতজ্ঞ হয়নি।(সূরা আশ-শু‘আরা ১৩২-১৩৪)

নবী হুদ আঃ এর সাথে আদ জাতির আচরণ :

অবাধ্য হয়ে পড়া আদ জাতিকে সত্যের পথে ফিরিয়ে আনতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের মধ্যে হযরত হুদ (আঃ)-কে নবী হিসেবে মনোনীত করলেন। তিনি তাদের সতর্ক করলেন এবং দাওয়াত দিলেন— “হে আমার কওমের ভাইয়েরা! তোমরা শির্ক থেকে নিজেদের মুক্ত রাখো, আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস স্থাপন করো, অহংকার ও অন্যায় থেকে বিরত থাকো, ন্যায়পরায়ণ ও মানবিক আচরণ করো।” কিন্তু তারা তাওহিদের পথে ফিরে না এসে নবী হুদ আঃ এর সাথে বৈরী আচরন করা শুরু করে। এবং মূর্তিপূজা ও শিরকি কাজে আরো বেশী সম্পৃক্ত হয়ে যায়। তারা এত বেশী অহংকারী হয়ে গিয়েছিল যে নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্যকে একমাত্র ক্ষমতার উৎস মনে করতে শুরু করে। এবং নিজেদের নবীর দাওয়াত গ্রহন না করে উপহাস বিদ্রুপ করা শুরু করে।

তারা বলত, “তুমি তো আমাদের মতোই একজন মানুষ! আল্লাহ কেন তোমাকে নবী করবেন?”
আবার কেউ বলত, “তুমি আমাদের দেবতাদের অবমাননা করছো, তাই তোমার ওপর কোনো অমঙ্গল আসবে।

তারা তাঁকে “মিথ্যাবাদী” ও “বুদ্ধি বিকৃত” বলে গালি দিত।

“তারা বলল, হে হুদ! তুমি তো আমাদের কাছে কোনো প্রমাণ আনোনি। আমরা তোমার কথায় আমাদের উপাস্যদের ত্যাগ করব না।”
— (সূরা হুদ ৫৩)

তারা বলত, আমাদের চেয়ে শক্তিশালী কে আছে? আমরা চাইলে তোমাকে ধ্বংস করে ফেলতে পারি! তারা হুদ (আঃ)-কে ও তাঁর অনুসারীদের সমাজচ্যুত করার হুমকি দেয়, এমনকি হত্যা করারও পরিকল্পনা করে।

একটা সময়ে তাঁকে সামাজিকভাবে বর্জন করা হয়, তাঁর অনুসারীদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়, এবং তাঁদের খাদ্য ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

তারা নিজেদেরকে দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী জাতি মনে করতো। তাই অহংকার মুলক আচরণ করতো কিন্তু আল্লাহ তাদের অহংকার মাত্র সাতদিন আট রাতেই নি:শেষ করে দিয়েছেন।
“তারা শক্তি নিয়ে গর্ব করত, কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিল—আল্লাহর কাছে শক্তিশালী আর কেউ নেই।”
— (সূরা ফুসসিলাত ১৫)

অবাধ্য আদ জাতি ধ্বংস হয়েছে যেভাবে –
হাজারো কষ্ট, নির্যাতন ও উপহাস উপেক্ষা করে নবী হুদ (আঃ) বারবার আদ জাতির সামনে তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন।
কিন্তু তারা সেই দাওয়াত গ্রহণ না করে উদ্ধতভাবে বলেছিল,

“তুমি কি আমাদের ভয় দেখাও বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার কারণে? আমরা শীঘ্রই বৃষ্টি নামতে দেখব!
এরপর আল্লাহ তাআলা তাঁদের ওপর প্রথমে তীব্র খরা ও দুর্ভিক্ষ পাঠালেন। তিন বছর ধরে বৃষ্টি বন্ধ থাকল। তবুও তারা তাওবা করেনি।
একদিন তারা দিগন্তে কালো মেঘ দেখতে পেয়ে আনন্দে বলল —“এ তো বৃষ্টি-ভরা মেঘ! এখন নিশ্চয়ই বৃষ্টি হবে!কিন্তু সেই মেঘ ছিল শাস্তির ঝড়।
আল্লাহ বলেন —
এটি ছিল এক ভয়ংকর বাতাস, যা তাদের ধ্বংস করেছিল — এমনভাবে যে তারা যেন খেজুরগাছের ভাঙা গুড়ির মতো পড়ে ছিল। (সূরা আল-হাক্কাহ, আয়াত ৬–৮)
এই ঝড় টানা সাত রাত ও আট দিন ধরে চলেছিল। পুরো আদ জাতি ধ্বংস হয়ে যায়।
শুধু হুদ (আঃ) ও তাঁর অনুসারীরা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়ার কারণে রক্ষা পান।
হযরত হুদ (আঃ)-এর প্রতি আদ জাতির অহংকার, অবিশ্বাস ও নির্যাতনই ছিল তাদের পতনের মূল কারণ।
আল্লাহ এমন বৃষ্টি ও ঝড় পাঠালেন যার গতি ছিল অত্যন্ত প্রবল — বাতাসের বেগ এত বেশি ছিল যে, তা তাদের অট্টালিকা, স্তম্ভ ও ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেয়।
যখন ঝড় থামে —
কোনো অট্টালিকা দাঁড়িয়ে ছিল না,
কোনো মানুষ জীবিত ছিল না,
মরুভূমি সমান হয়ে যায়,
সব স্থাপনা বালির নিচে মিলিয়ে যায়।
আল্লাহ কুরআনে বলেন — “আমি তাদের এমনভাবে ধ্বংস করলাম যে তাদের কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট রইল না।”
— (সূরা আল-আহকাফ, আয়াত ২৫)

সামূদ জাতি
আরব উপদ্বীপের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে, মদীনা ও তাবুক শহরের মাঝামাঝি অবস্থিত হিজর বা মাদায়েন সালেহ নামক এলাকায় সামূদ জাতির বসবাস ছিল।
আদ জাতির ধ্বংসের পর সামূদ জাতি পৃথিবীতে প্রতাপশালী ও প্রভাবশালী জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
তারা পাহাড় কেটে সুন্দর সুন্দর ঘর ও দুর্গ নির্মাণ করেছিল, যার নিদর্শন আজও মাদায়েন সালেহ অঞ্চলে দেখা যায়।

পবিত্র কুরআনে সামূদ জাতির বৈশিষ্ট্য যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে

১. তারা নিরাপত্তার জন্য পাহাড় কেটে ঘর বানাত।
তোমরা পাহাড়কে কেটে ঘর বানাও নিরাপত্তার জন্য।
(সূরা আশ-শু’আরা, আয়াত ১৪৯)
আজও মাদায়েন সালেহ অঞ্চলে তাদের খোদাই করা শিলাঘরগুলো দেখা যায়।

২. তারা ছিল শারীরিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী ও বলবান।

৩. কৃষিকাজ, পশুপালন ও নির্মাণকাজে তারা ছিল অসাধারণ দক্ষতার অধিকারী।
তাদের এলাকায় উর্বর ভূমি ও প্রচুর পানির উৎস ছিল, যার ফলে তারা কৃষি ও বাণিজ্যে সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল।

৪. শক্তি, সম্পদ ও সমৃদ্ধির কারণে তারা আদ জাতির মতোই অহংকারী হয়ে ওঠে।
তারা আল্লাহর সঙ্গে শিরক করে এবং তাঁর আদেশ অমান্য করতে থাকে।

তাদেরকে সঠিক পথের দিশা দিতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের মধ্য থেকে হযরত সালেহ (আঃ)-কে নবুয়তের দায়িত্ব দেন।
কিন্তু তারা আল্লাহর নবীকে অস্বীকার করে এবং অবাধ্যতার পথে অটল থাকে।

সালেহ (আঃ)-এর সাথে সামূদ জাতির আচরণ
১.দাওয়াত প্রত্যাখ্যান ও উপহাস
হযরত সালেহ (আঃ) তাদেরকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদতে আহ্বান করেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন —
“হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো উপাস্য নেই।”
(সূরা হুদ, আয়াত ৬১)
কিন্তু সামূদ জাতি বলেছিল —
“হে সালেহ! তুমি তো আমাদের মধ্যে একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলে, এখন তুমি কি আমাদের সেই উপাসনা থেকে ফিরিয়ে দিতে চাও, যা আমাদের পূর্বপুরুষরা করত?”
(সূরা হুদ, আয়াত ৬২)
তারা সালেহ (আঃ)-এর কথা শুনল না, বরং তাকে মিথ্যাবাদী ও পাগল বলে উপহাস করল।

২.আল্লাহর নিদর্শন উটনাকে অস্বীকার ও হত্যা
সালেহ (আঃ)-এর দাওয়াত প্রমাণের জন্য আল্লাহ তাদের কাছে এক অলৌকিক উটনি (আল্লাহর উটনি) পাঠিয়েছিলেন,
যাকে তারা সম্মান করতে ও কষ্ট না দিতে নির্দেশ পেয়েছিল।
সালেহ (আঃ) বলেছিলেন —
“এটি আল্লাহর উটনি, এটি তোমাদের জন্য একটি নিদর্শন। একদিন এটি পানি পান করবে, আর একদিন তোমরা।”
(সূরা আশ-শু’আরা, আয়াত ১৫৫)
কিন্তু অহংকারে তারা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে উটনিটিকে হত্যা করে ফেলে।
এটি ছিল তাদের সবচেয়ে বড় অপরাধ।

৩.বিদ্বেষ ও হত্যার ষড়যন্ত্র
উটনি হত্যার পর তারা সালেহ (আঃ)-এর প্রতি আরো ক্ষুব্ধ হয়।
তারা তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল।
কুরআনে এসেছে —
“তারা আল্লাহর রাসূলকে হত্যার চক্রান্ত করেছিল।”
(সূরা আন-নামল, আয়াত ৪৮–৪৯)
কিন্তু আল্লাহ তাঁকে রক্ষা করেন এবং তাদের ওপর শাস্তি পাঠান।

শাস্তি ও ধ্বংস
তাদের অবাধ্যতার কারণে আল্লাহ তাদের উপর ভয়ংকর ভূমিকম্প ও বজ্রধ্বনির শাস্তি পাঠান।
“তখন তাদের উপর এক ভয়াবহ শব্দ পতিত হলো, আর তারা ঘরে মাটিতে উপুড় হয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ল।”
(সূরা হুদ, আয়াত ৬৭)
পুরো জাতি ধ্বংস হয়ে যায়, কেবল সালেহ (আঃ) ও তাঁর মুমিন অনুসারীরা রক্ষা পান।

সূরা আল-আনকাবুতে আল্লাহ বলেন :
“আর আদ ও সামূদের কাহিনি তো তোমাদের জানা। তাদের বসতিগুলো থেকে তোমরা অতিক্রম করো। শয়তান তাদের কর্মকাণ্ডকে তাদের কাছে শোভন করেছিল, তাই তারা সৎপথ থেকে বিচ্যুত হয়েছিল।

চলবে – বই মানব সভ্যতা: রক্তে লেখা ইতিহাস – লেখক – আবু নাঈম মু শহীদুল্লাহ্


Share Option;

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *