ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীল:
দুনিয়ার অন্যান্য সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীলদের পার্থক্য সুস্পষ্ট। ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব শুধু একটি সাংগঠনিক অবস্থান নয়, বরং এটি একটি আমানত, যা তাকওয়া, নৈতিকতা এবং আল্লাহভীতির ভিত্তিতে গড়ে উঠতে হয়।
এই দায়িত্ব পালনের পথে অনেক সময় চোখের সামনে অসংখ্য সুযোগ আসে—মর্যাদা, প্রভাব, আর্থিক লাভ কিংবা অন্যান্য প্রলোভন। কিন্তু যদি সে সুযোগে কোনো সন্দেহ থাকে, অথবা শরীয়তের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ হয়, তবে একজন খোদাভীরু দায়িত্বশীল নির্দ্বিধায় তা পরিহার করবেন। তিনি দুনিয়ার স্বল্পমেয়াদী লাভের চেয়ে আখিরাতের সফলতাকে অগ্রাধিকার দেবেন।
ব্যক্তিগত জীবনে খোদাভীতি ও নৈতিকতা চর্চা ইসলামী আন্দোলনের মূল ভিত্তি। কারণ ব্যক্তি চরিত্রই আন্দোলনের প্রাণশক্তি। দায়িত্বশীলরা যদি আত্মশুদ্ধি ও নৈতিকতা অর্জনে অগ্রণী না হন, তবে গোটা আন্দোলনের উদ্দেশ্যই ব্যাহত হতে পারে। যে দায়িত্বশীল যত বেশী তাকওয়াবান আল্লাহ তাকে ততবেশী মর্যাদার অধিকারী করেন। আল্লাহ বলেন :
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ
“নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন সে, যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু।”
(সূরা হুজরাত: ১৩)
রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন
قالَ رَسُولُ االله صَلّى االلهُ عَلَيْهِ وسَلَّم: »إِنَّ االله لا يَنْظُرُ إِلى أَجْسامِكْم ، وَلا إِلى صُوَرِآُمْ ، وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعمالِكُمْ « رواه مسلم
“আল্লাহ তোমাদের চেহারা ও ধন-সম্পদ দেখে না; বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমল দেখে।”
(সহীহ মুসলিম)
অর্থাৎ ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীলগণ তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত হবেন।
তাকওয়ার পাশাপাশি দ্বীন ও দুুনিয়ারর জ্ঞানে প্রাজ্ঞ হবেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন :
قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ
বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান? (সূরা যুমার: ৯)
রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন
مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ، وَإِنَّمَا أَنَا قَاسِمٌ، وَاللهُ يُعْطِي، وَلَنْ تَزَالَ هَذِهِ الْأُمَّةُ قَائِمَةً عَلَى أَمْرِ اللهِ، لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَالَفَهُمْ، حَتَّى يَأْتِيَ أَمْرُ اللهِ». [صحيح]
আল্লাহ তা‘আলা যার দ্বারা কল্যাণ চান, তাকে দীনের জ্ঞান দান করেন। আল্লাহই দানকারী, আর আমি বণ্টনকারী। এ উম্মত আল্লাহর আদেশ (কিয়ামাত) আসা পর্যন্ত সর্বদা আল্লাহর হুকুমের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, বিরুদ্ধবাদীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
আল্লাহর নবী হযরত ইউসুফ (আ.) মিশরের দুঃসময়ে কি চমৎকার ভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি তার যোগ্যতার আলোকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে সফল হয়েছিল
اجْعَلْنِي عَلَىٰ خَزَائِنِ الْأَرْضِ ۖ إِنِّي حَفِيظٌ عَلِيمٌ
“
আমাকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের দায়িত্বে নিযুক্ত করুন, আমি একজন বিশ্বস্ত এবং জ্ঞানী ব্যক্তি।”
(সূরা ইউসুফ: ৫৫)
ইসলামী আন্দোলনের একজন দায়িত্বশীল নেতৃত্বদানের দক্ষতা, সময় ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা প্রণয়নের সক্ষমতা, বিপদে আপদে সবর ও দৃঢ়তা, সর্বোপরি ন্যায় ও ইনসাফ পূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজের অন্যান্য রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর সাথে ভারসাম্যপূর্ন সম্পর্ক রাখা।
সংগঠক/দায়িত্বশীলের গুণাবলী :
আন্দোলনের সফলতার জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী ও যোগ্য নেতৃত্ব, তথা দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্ব। আমাদের সমাজের প্রভাবশালী ও যোগ্য নেতৃত্বের অধিকারী অনেকেই মানব রচিত মতবাদগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও, ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে তাঁদের সম্পৃক্ততার হার তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির। তবে ইসলামী আন্দোলন সফল হলে উচ্চবিত্ত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা রাষ্ট্রের যোগ্য কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালনে দ্বিধা করেন না।
ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থার নাম। তাই ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিও হবেন এমন একজন, যিনি সমাজের সকল শ্রেণির মানুষকে সঙ্গে নিয়ে চলতে সক্ষম — একজন ভারসাম্যপূর্ণ দায়িত্বশীল।
শুধুমাত্র মসজিদের ইমামতি করা, খানকায় বসে নসিহত দেওয়া কিংবা ওয়াজ-মাহফিল করেই দায়িত্ব পালন সম্পূর্ণ হয় না।
ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীলকে চোখ কান খোলা রেখে আন্দোলনের মুল লক্ষ্যে হাসিলে এগিয়ে যেতে হয়। তবে একজন দায়িত্বশীলের ব্যক্তি চরিত্রে
কিছু মৌলিক গুনাবলী প্রয়োজন :
১. তাকওয়া (আল্লাহভীতি)
Taqwa (God-consciousness)
২. আমানতদারিতা ও বিশ্বস্ততা
Trustworthiness and Integrity
৩. ইলম (জ্ঞান ও বোধ)
Knowledge and Insight
৪. হিকমাহ (প্রজ্ঞা ও কৌশলী দৃষ্টিভঙ্গি)
Wisdom and Strategic Thinking
৫. সবর ও সহনশীলতা
Patience and Tolerance
৬. আখলাক ও চারিত্রিক দৃঢ়তা
Good Character and Moral Strength
৭. পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মানসিকতা
Consultative Decision-Making (Shura)
৮. ইখলাস (নিয়তের বিশুদ্ধতা)
Sincerity of Intention (Ikhlas)
৯. পরিশ্রম প্রিয়তা ও সময়ানুবর্তিতা
Diligence and Time Discipline
১০. উম্মাহর প্রতি দরদ ও দায়িত্ববোধ।
Compassion and Responsibility Towards the Ummah
ইসলামী আন্দোলনে দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতা:
মানবতার ধর্ম ইসলাম — এটি কেবল কোনো মৌখিক বক্তব্য নয়; বরং ইসলামে রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতিসহ সকল বিষয়েই মানুষের কল্যাণের জন্য উত্তমভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
মানুষের জীবনের এমন কোনো দিক নেই, যা আল-কুরআনে বর্ণিত হয়নি। কুরআনের বিধানের আলোকে মানুষের জন্য কল্যাণমুখী একটি সমাজ গঠনে যারা কাজ করবে ও দায়িত্ব পালন করবে, তাদেরকে দায়িত্বশীলতা এবং জবাবদিহিতার—এই উভয় বিষয়েই সচেতন থাকতে হবে। দায়িত্ব পালনের সময় যদি জবাবদিহিতা না থাকে, তাহলে স্বেচ্ছাচারিতা বৃদ্ধি পায়।
১. দায়িত্বশীলতা (Responsibility):
একজন ব্যক্তি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব আন্তরিকতার সাথে ও যথাযথভাবে পালন করলে তা-ই দায়িত্বশীলতা। ইসলামী আন্দোলনের প্রতিটি কর্মীর কাঁধে একটি বড় দায়িত্ব অর্পিত — তা হলো, সমাজে দ্বীনের কাজকে প্রতিষ্ঠা করা।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনের সুরা আহযাবের ৭২নং আয়াতে বলেন :-
اِنَّا عَرَضْنَا الْاَمَانَةَ عَلَى السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ الْجِبَالِ فَاَبَیْنَ اَنْ یَّحْمِلْنَهَا وَ اَشْفَقْنَ مِنْهَا وَ حَمَلَهَا الْاِنْسَانُ١ؕ اِنَّهٗ كَانَ ظَلُوْمًا جَهُوْلًاۙ
আমি এ আমানতকে আকাশসমূহ, পৃথিবী ও পর্বতরাজির ওপর পেশ করি, তারা একে বহন করতে রাজি হয়নি এবং তা থেকে ভীত হয়ে পড়ে। কিন্তু মানুষ একে বহন করেছে, নিঃসন্দেহে সে বড় জালেম ও অজ্ঞ।
এ কঠিন কাজটি দায়িত্বশীলতার সহিত প্রতিটি কর্মীকে করতে হবে রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন
أَلاَ كُلُّكُمْ رَاعٍ، وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، فَالإِمَامُ الَّذِي عَلَى النَّاسِ رَاعٍ وَهْوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ وَهْوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى أَهْلِ بَيْتِ زَوْجِهَا وَوَلَدِهِ وَهِيَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُمْ، وَعَبْدُ الرَّجُلِ رَاعٍ عَلَى مَالِ سَيِّدِهِ وَهْوَ مَسْئُولٌ عَنْهُ، أَلاَ فَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ
জেনে রেখো! তোমাদের প্রত্যেকেই একজন দায়িত্বশীল; আর তোমরা প্রত্যেকেই নিজ অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব ইমাম, যিনি জনগণের দায়িত্বশীল তিনি তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। পুরুষ গৃহকর্তা তার পরিবারের দায়িত্বশীল; সে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী তার স্বামীর পরিবার, সন্তান-সন্ততির উপর দায়িত্বশীল, সে এসব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। কোন ব্যাক্তির দাস স্বীয় মালিকের সম্পদের দায়িত্বশীল; সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব জেনে রাখ, প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্বাধীন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।
২. জবাবদিহিতা (Accountability):
জবাবদিহিতা হচ্ছে মানুষ তার উপর অর্পিত দায়িত্ব বা কাজের বর্ণনা দেওয়া বা যথাযথ দায়িত্ব পালনের জবাব দেয়া।
একজন দায়িত্বশীল দুনিয়াতে জবাবদিহি করবেন সংগঠনের নেতৃত্ব, সংগঠনের শুরা এবং সাধারণ মানুষ/কর্মীদের কাছে। আর আখেরাত মহান আল্লাহর তা’লার কাছে।
সুরা আল-হিজরের ৯২ এবং ৯৩ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন:
فَوَرَبِّكَ لَنَسْئَلَنَّهُمْ اَجْمَعِیْنَۙ- عَمَّا كَانُوْا یَعْمَلُوْنَ
তোমার রবের কসম, আমি অবশ্যি তাদের সবাইকে জিজ্ঞেস করবো,তোমরা কি কাজে নিয়োজিত ছিলে?
রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন –
عَنِ بْنِ مَسْعُودٍ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَا تَزُولُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ حَتَّى يَسْئَلَ عَنْ خَمْسٍ عَنْ عُمُرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَا أَبْلَاهُ وَعَنْ مَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ وَمَ عَمِلَ فِيْمَا عَلِمَ (ترمذ ی)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) নবী করিম (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, কিয়ামতের দিন আদম সন্তানকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক কদমও স্ব-স্থান হতে নড়তে দেওয়া হবে না।
তা হলো- ১) তার জীবনকাল কিভাবে অতিবাহিত করেছে, ২) যৌবনের সময়টা কিভাবে ব্যয় করেছে, ৩) ধন সম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছে, ৪) এবং তা কিভাবে ব্যয় করেছে, ৫) সে দ্বীনের (ইসলাম) যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছে সেই অনুযায়ী আমল করেছে কিনা বা কতটুকু করেছে।
জবাবদিহিতার মানষিকতা নিয়ে কাজ করলে একজন দায়িত্বশীল জনশক্তির শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় সিক্ত হয়।
কর্মীদের মধ্যে দায়িত্ববোধ:
সংগঠনের নিয়ম-কানুন মেনে চলা।
দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে সম্পন্ন করা।
পারস্পরিক জবাবদিহিতা:
নেতৃত্ব এবং কর্মীদের মধ্যে দ্বিমুখী জবাবদিহিতার ধারা গড়ে তোলা।
সমালোচনাকে গ্রহণযোগ্য করা এবং পর্যালোচনার ব্যবস্থা রাখা।
ইসলামী আন্দোলনের সাফল্য নির্ভর করে দায়িত্বশীল ও কর্মীদের আন্তরিকতা, দায়িত্বশীলতা এবং সর্বোপরি আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতির উপর। যাদের মধ্যে দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতা নেই, তারা কখনো একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি সমাজ বিনির্মান করতে পারবে না।
সংগঠনকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে মাঝেমধ্যে দায়িত্বশীলকে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়:
সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ বা দায়িত্ব পালনে অবহেলার কারেন, অনেক সময় শপথের জনশক্তিদের পদ মুলতবি করা হয়ে থাকে। আমাদের আন্দোলনের মেধাবী চৌকস ও পরিশ্রমী অনেকে এমন পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছে। আবার আনুগত্যের প্রকাশের মাধ্যমে অনেকে ফিরে এসেছেন।
চালাক প্রকৃতির জনশক্তিরা আন্দোলনের কাজ ফাঁকি দিয়ে অযুহাত পেশ করে স্বপদে বহাল থেকে যায়। অনেকে এই বিষয়টাকে দায়িত্বশীলের রোষানল বলে দায়িত্বশীলকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়। এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ সাঃ এর একজন সাহাবী কা’ব ইবনে মালিক (রা)-র ঘটনাটি তুলে ধরলাম –
কা’ব ইবনে মালিক (রা) অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তাঁর পুত্র আবদুল্লাহ তাঁর পরিচালক ছিলেন।
আবদুল্লাহ বলেন, তাবুকের জিহাদে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে না গিয়ে পেছনে রয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমার পিতা আমাকে বলেন:-
তাবুকের জিহাদ ছাড়া আমি কোনো জিহাদে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আলাদা ছিলাম না। তবে বদরের জিহাদ থেকেও আমি দূরে রয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এই জিহাদে যারা শরীক হননি তাদের কাউকে শাস্তি দেয়া হয়নি।
তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলিমগণ কুরাইশদের ব্যবসায়ী কাফিলার ধন-সম্পদ ছিনিয়ে নেবার উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছিলেন। অবশেষে আল্লাহ তাআলা (বাহ্যত) অসময়ে মুসলমানদেরকে তাদের দুশমনদের সাথে সংঘর্ষের সম্মুখীন করে দিলেন। আমরা আকাবার রাতে যখন ইসলামের উপর কায়েম থাকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তখন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম। যদি বদরের জিহাদ মানুষের মধ্যে বেশি স্মরণীয়, তবুও আমি আকাবায় উপস্থিতির বদলে বদরের উপস্থিতিকে অধিক প্রিয় মনে করি না। তাবুকের জিহাদে আমার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে না যাওয়ার বিবরণ এই যে,
এই জিহাদের সময় আমি যতটা শক্তিশালী ও ধনবান ছিলাম এতটা আর কোন সময় ছিলাম না। আল্লাহর শপথ! এ জিহাদের সময় আমার দু’টি উট ছিল কিন্তু এর পূর্বে আমার দু’টি উট ছিল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোথাও জিহাদে যাওয়ার ইচ্ছা করলে (সরাসরি না বলে ইংগিতবহ শব্দ দ্বারা) অন্যভাবে তা প্রকাশ করতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যধিক গরমের সময় তাবুকের জিহাদে যান। সফর ছিল অনেক দূরের। অঞ্চল ছিল খাদ্য ও পানিহীন। আর শত্রু সৈন্যের সংখ্যাও ছিল বেশি। তাই তিনি মুসলিমদের কাছে এই জিহাদের কথা খুলে বলে দিলেন, যাতে সবাই জিহাদের জন্য ঠিকমত প্রস্তুত হতে পারেন। তিনি তাঁদেরকে তাঁর ইচ্ছা জানিয়ে দিলেন। বহু মুসলিম মুজাহিদ এ জিহাদে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলেন। সে সময়ে তাঁদের নাম তালিকাভুক্ত করার জন্য কোন রেজিস্ট্রি বই ছিল না। কা’ব (রা) বলেন, যে লোক জিহাদে যোগদান না করে আত্মগোপন করতে চাইতো সে অবশ্যই মনে করত যে, যতক্ষণ পর্যন্ত তার সম্পর্কে ওহী নাযিল না হবে ততক্ষণ তার ভূমিকা গোপন থাকবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এ জিহাদে যান তখন গাছে ফল পেকে গিয়েছিল এবং গাছপালার ছায়াও আরামদায়ক হয়ে উঠেছিল। আমি এসবের প্রতি আকৃষ্ট ছিলাম। যাহোক, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাথে মুসলিমগণ প্রস্তুতি শুরু করলেন। আমিও তাঁর সাথে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতির উদ্দেশে সকাল বেলা যেতাম বটে, কিন্তু কোন কিছু না করেই ফিরে আসতাম এবং মনে মনে ভাবতাম যে, আমি ইচ্ছা করলেই এ কাজ করতে পারব। এভাবে গড়িমসি করতে করতে অনেক দিন চলে গেল, এমনকি লোকেরা সফরের জোর প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম মুজাহিদদের নিয়ে রওয়ানা হলেন, কিন্তু আমি কোন প্রস্তুতিই নিলাম না। কিছু কাল আমার এই গড়িমসি চলতে লাগল। ওদিকে মুজাহিদগণ দ্রুত অগ্রসর হয়ে গিয়েছেন এবং জিহাদও সন্নিকটে। আমি তখন লক্ষ্য করলাম যে, রওয়ানা হয়ে যাওয়ার পর আমি যখন লোকদের মধ্যে চলাফেরা করতাম, তখন যাদেরকে মুনাফিক বলা হত এবং যাদেরকে আল্লাহ অক্ষম ও দুর্বল বলে গণ্য করেছিলেন সেই রকমের লোক ছাড়া আর কাউকে আমার মত ভূমিকায় দেখতে পেতাম না। এ অবস্থা আমাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিত।
তাবুকে পৌঁছা পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কথা স্মরণ করেননি। তাবুকে তিনি লোকজনের মধ্যে বসা অবস্থায় জিজ্ঞেস করলেন, কা’ব ইবনে মালিক কি করল? বনু সালেমার একজন বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাকে তার চাদর ও শরীরের দুই পার্শ্বদেশ দর্শন আটকে রেখেছে। মু’আয ইবনে জাবাল রাদিআল্লাহু আনহু তাকে বলেন, তুমি যা বললে তা খারাপ কথা। আল্লাহর শপথ! ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা তো তার ব্যাপারে ভালো ছাড়া আর কিছু জানি না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুপ রইলেন। এমন অবস্থায় তিনি সাদা পোশাক পরিহিত একজন লোককে মরুভূমির মরীচিকার মধ্য দিয়ে আসতে দেখে বলেন, তুমি আবু খাইসামা? দেখা গেল তিনি সত্যিই আবু খাইসামা আনসারী (রা)। আর আবু খাইসামা হচ্ছেন সেই ব্যক্তি মুনাফিকরা যাঁকে টিটকারি দিয়েছিল তিনি এক সা খেজুর দান করেছিলেন বলে। কা’ব (রা) বলেন, যখন তাবুক থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের ফিরে আসার খবর পেলাম তখন আমার খুব দুশ্চিন্তা হল। তাই মিথ্যা ওজর ভাবতে লাগলাম। (মনে মনে) বলতে লাগলাম, কিভাবে তাঁর অসন্তোষ থেকে বাঁচতে পারি। আমার পরিবারবর্গের বুদ্ধিমান লোকদের নিকট সাহায্য চাইলাম। তারপর যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিরে আসছেন বলে খবর পাওয়া গেল, তখন মিথ্যা বলার ইচ্ছা দূর হয়ে গেল, এমনকি কোন কিছু দ্বারা মুক্তি পাব না বলে বুঝতে পারলাম, তাই সত্য কথা বলার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলাম।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিরে এলেন। আর তিনি সফর থেকে ফিরে এসে প্রথমে মসজিদে গিয়ে দুই রাক’আত নামায আদায় করতেন, তারপর লোকজনের সামনে বসতেন। এ নিয়ম অনুযায়ী তিনি যখন বসলেন, তখন যারা এ জিহাদে যোগদান করেনি, তারা শপথ করে ওজর পেশ করতে লাগল। এরূপ লোক ছিল আশিজনের বেশি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের প্রকাশ্য বক্তব্য গ্রহণ করলেন, তাদের বাইয়াত গ্রহণ করলেন এবং তাদের গুনাহর জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তাদের গোপন অবস্থা আল্লাহর নিকট সোপর্দ করলেন। অবশেষে আমি হাযির হয়ে যখন সালাম দিলাম, তিনি রাগের হাসি হাসলেন, তারপর কাছে ডাকলেন। আমি তাঁর সামনে গিয়ে বসে পড়লাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেন পেছনে রয়ে গেলে? তুমি তোমার বাহন কিনেছিলে না? কা’ব (রা) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল। আমি যদি আপনি ছাড়া অন্য কোন দুনিয়াদার লোকের সামনে বসতাম, তাহলে কোন ওজর দ্বারা তার অসন্তোষ থেকে বাঁচবার পথ দেখতে পেতাম। যুক্তি প্রদর্শনের যোগ্যতা আমার আছে। আল্লাহর শপথ! আমি জানি, যদিও আজ আমি আপনার নিকট মিথ্যা কথা বললে তাতে আপনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হবেন, কিন্তু আল্লাহ আপনাকে আমার প্রতি অতি শীঘ্রই অসন্তুষ্ট করে দেবেন। আর সত্য কথা বলায় আপনি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হলেও আমি আল্লাহ্র নিকট ভাল পরিণতির আশা করি। আল্লাহর শপথ! আমার কোন ওজর ছিল না। আল্লাহর শপথ! এ জিহাদে আপনার সাথে না গিয়ে পেছনে রয়ে যাওয়ার সময় আমি যতটা শক্তিমান ও অর্থশালী ছিলাম অতটা অন্য কোন সময় ছিলাম না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : সে সত্য কথাই বলেছে। আচ্ছা উঠে যাও। তোমার ব্যাপারে আল্লাহ কোন ফায়সালা করা পর্যন্ত দেখা যাক।
বনী সালেমার কয়েকজন লোক আমার পেছনে পেছনে এসে আমাকে বলতে লাগল, আল্লাহর শপথ। ইতিপূর্বে তুমি কোন অপরাধ করেছ বলে আমরা জানি না। তুমি কি অন্য লোকদের মত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ওজর পেশ করতে পারলে না? তোমার গুনাহর জন্য আল্লাহর নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষমা প্রার্থনাই তো যথেষ্ট হয়ে যেত। এরা আমাকে এত তিরস্কার করতে লাগল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফিরে গিয়ে নিজেকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করার আমার ইচ্ছা হল। তারপর আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার মত এরূপ ব্যাপার আর কারও ঘটেছে কি? তারা বলল, হাঁ আরও দু’জনের ব্যাপারও তোমার মতই ঘটেছে। তুমি যা বলেছ, তারাও সেই রকমই বলেছে। আর তোমাকে যা বলা হয়েছে, তাদেরকেও তাই বলা হয়েছে। কা’ব (রা) বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, সে দু’জন কে কে? লোকেরা বলল, তারা হচ্ছেন মুরারা ইবনে রবীআ আমেরী ও হিলাল ইবনে উমাইয়া ওয়াকেফী (রা)।
কা’ব (রা) বলেন, লোকেরা আমাকে যে দু’জন লোকের নাম বলল, তারা ছিলেন খুবই সৎ ও আদর্শ পুরুষ এবং বদরের জিহাদে তারা যোগদান করেছিলেন। কা’ব বলেন, লোকেরা উক্ত দু’জনের খবর দিলে আমি আমার পূর্বের নীতির উপর অবিচল রইলাম।
যারা পেছনে রয়ে গিয়েছিল তাদের মধ্য থেকে আমাদের তিনজনের সাথে লোকদেরকে কথা বলতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করে দিলেন। কাজেই সব লোক আমাদের নিকট থেকে দূরে থাকতে লাগল। এমনকি আমার জন্য দুনিয়া একেবারে অপরিচিত হয়ে গেল। পরিচিত দেশ আমার জন্য অপরিচিত হয়ে গেল। এভাবে আমরা পঞ্চাশ দিন পর্যন্ত থাকলাম। আমার দু’জন সাথী ঘরের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়লেন এবং তারা ঘরে বসে বসে কাঁদতে থাকলেন। আমি নওজোয়ান ও শক্তিশালী ছিলাম। তাই আমি বাইরে বের হয়ে মুসলিমদের সাথে নামায পড়তাম এবং বাজারে চলাফেরা করতাম, কিন্তু কেউ আমার সাথে কথা বলত না। নামাযের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর স্থানে বসলে আমি তাঁকে সালাম দিতাম এবং মনে মনে ভাবতাম দেখি তিনি সালামের জওয়াব দিতে ঠোঁট নাড়েন কি না। তারপর আমি তাঁর নিকটবর্তী স্থানে নামায পড়তাম এবং চুপে চুপে দেখতাম তিনি আমার দিকে তাকান কিনা। আমি যখন নামাযে মশগুল হতাম তখন তিনি আমার দিকে তাকাতেন। আবার আমি যখন তাঁর দিকে তাকাতাম, তখন তিনি আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন।
এভাবে যখন মুসলিম সমাজের অসহযোগিতার দরুন আমার এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হল,তখন আমি (একদিন) আবু কাতাদা (রা)-র বাগানের দেওয়াল টপকে তাঁকে সালাম দিলাম। আল্লাহর শপথ। সে আমার সালামের জওয়াব দিল না। অথচ সে ছিল আমার চাচাত ভাই ও প্রিয়তম বন্ধু। আমি তাকে বললাম, আবু কাতাদা! আমি তোমাকে আল্লাহ্’র শপথ দিয়ে জিজ্ঞেস করছি, তুমি কি জান না যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসি? সে চুপ রইল। আমি আবার তাকে শপথ করে জিজ্ঞেস করলাম। সে চুপ করে থাকল। আমি আবার শপথ করলে সে বলল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। এ কথায় আমার দু’ চোখ ফেটে পানি বের হয়ে এলো। আমি দেওয়াল পার হয়ে ফিরে এলাম। এরপর আমি একদিন মদীনার বাজারে ঘুরছিলাম, এমন সময় মদীনায় খাদ্যদ্রব্য বিক্রয় করার জন্য আগত এক সিরিয়াবাসী কৃষক আমাকে খুঁজতে লাগলো। লোকেরা তাকে আমার দিকে ইঙ্গিত করতে লাগল। সে আমার কাছে এসে আমাকে গাস্স্সান বাদশাহের একটি পত্র দিল। আমি পত্রটি পড়লাম। তাতে লেখা ছিল,
আমরা জানতে পারলাম, তোমার সাথী (রাসূলুল্লাহ (রাসূলুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তোমার উপর ক্ষুব্ধ হয়েছে। আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার স্থানে থাকবার জন্য সৃষ্টি করেননি। তুমি আমাদের সাথে মিলে যাও, আমরা তোমাকে সাহায্য করব। পত্র পড়ে আমি বললাম, এটাও আমার জন্য পরীক্ষা। আমি পত্রটি চুলায় নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে ফেললাম।
এভাবে পঞ্চাশ দিনের চল্লিশ দিন চলে গেল। আর কোন ওহীও নাযিল হল না। হঠাৎ একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক সংবাদদাতা এসে আমাকে জানান, রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে আমার স্ত্রী থেকে পৃথক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। আমি বললাম, আমি কি তাকে তালাক দেব অথবা অন্য কিছু করব? সংবাদদাতা বলেন, না তুমি তার থেকে পৃথক থাকবে, তার সাথে থাকবে না। আমার অন্য দু’জন সাথীকেও উক্তরূপ খবর দেয়া হয়েছে।
আমি স্ত্রীকে বললাম, তুমি তোমার বাপের বাড়ি চলে যাও এবং আল্লাহ যতক্ষণ পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোন ফায়সালা না করেন ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি তাদের কাছেই থাক। হেলাল ইবনে উমাইয়ার স্ত্রী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! হিলাল ইবনে উমাইয়া খুবই বুড়ো মানুষ, তার কোন খাদেম নেই। আমি তার খিদমত করলে আপনি কি অপছন্দ করবেন? তিনি বললেন, না। তবে সে যেন তোমার সাথে সহবাস না করে। উমাইয়ার স্ত্রী বলেন, আল্লাহর শপথ। এ ব্যাপারে তার কোন শক্তিই নেই। আল্লাহর শপথ! এই দিন পর্যন্ত তার ব্যাপারে যা কিছু হচ্ছে তাতে সে সর্বদা কাঁদছে। (কা’ব বলেন) আমার পরিবারের কেউ আমাকে বলল, তুমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে তোমার স্ত্রীর (খিদমত নেয়ার) ব্যাপারে অনুমতি নিতে পারতে। তিনি তো হিলাল ইবনে উমাইয়ার খিদমত করার জন্য তার স্ত্রীকে অনুমতি দিয়েছেন। আমি বললাম, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এ ব্যাপারে অনুমতি চাইব না। না জানি এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অনুমতি চাইলে তিনি কি বলেন। আর আমি হচ্ছি একজন নওজোয়ান।
এভাবে (আরও) দশ দিন কাটালাম। আমাদের সাথে কথা বলা নিষিদ্ধ ঘোষণার পর থেকে পূর্ণ পঞ্চাশ দিন গত হল। তারপর আমি আমার এক ঘরের ছাদে পঞ্চাশতম দিনের ভোরে ফজরের নামায আদায় করে এমন অবস্থায় বসে ছিলাম যে অবস্থার প্রেক্ষিতে আল্লাহ আল কুরআনে আমাদের সম্পর্কে বলেছেন: আমার মন ছোট হয়ে গেছে এবং পৃথিবী প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও আমার জন্য সংকীর্ণ হয়ে গেছে।
আমি এ অবস্থায় বসে আছি, এমন সময় সাআ পাহাড়ের উপর থেকে একজন লোককে (আবু বাক্স আস্ সিদ্দীক) চিৎকার করতে শুনলাম। তিনি উচ্চস্বরে বলছিলেন, হে কা’ব! তুমি সুসংবাদ গ্রহণ কর। আমি এ কথা শুনে সিজদায় পড়ে গেলাম এবং বুঝতে পারলাম যে, মুক্তির বার্তা এসেছে। আল্লাহ যে আমাদের তাওবা কবুল করেছেন, এ খবর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের নামায শেষে সমস্ত লোককে জানিয়ে দিলেন। এতে লোকেরা আমাদের সুখবর দিতে এলো। কতিপয় লোক আমার দু’জন সাথীকে সুখবর দিতে গেল। আর একজন লোক দৌড়ে গিয়ে পাহাড়ের উপর উঠল। ঘোড়ার চেয়ে শব্দের গতি ছিল বেশি দ্রুতগামী। যিনি আমাকে সুখবর দিচ্ছিলেন তার আওয়ায আমি যখন শুনতে পেলাম, তখন আমি তার সুখবর দেয়ার জন্য (আনন্দের আতিশয্যে) নিজের’ কাপড় দু’খানা খুলে তাকে পরিয়ে দিলাম। আল্লাহর শপথ! সেদিন ঐ দু’খানা কাপড় ছাড়া আর কোন কাপড় আমার ছিল না। আমি অপর দু’খানা কাপড় ধার করে নিলাম এবং তা পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম।