১২ই ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
রাত ১১:৫০
১২ই ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
রাত ১১:৫০

পৃথিবীর প্রথম সভ্যতা — আবু নাঈম মু শহীদুল্লাহ্

Share Option;

এ পৃথিবীতে বহু সভ্যতা গড়ে উঠেছে এবং বিলীন হয়েছে। প্রতিটি সভ্যতার পরিবর্তনের পেছনে ছিল পরিবেশগত পরিবর্তন, যুদ্ধ, সাংস্কৃতিক বিনিময়, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও ধর্মীয় প্রভাব।
একটি চলমান সমাজব্যবস্থার উপর নতুন সভ্যতা বা সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা মোটেই ঠুনকো বিষয় নয়। এর জন্য প্রয়োজন হয়েছে সংস্কারক, বিপ্লবী ও সহযোগী/সহযোদ্ধাদের—যারা নিজেদের লক্ষ্যের বাস্তবায়নে জীবন বাজি রেখে লড়ে গিয়েছেন এবং জনতার জন্য পরিবর্তন এনে দিয়েছেন।

প্রাচীন সভ্যতা যেমন মেসোপটেমিয়া, মিশরীয়, সিন্ধু, চীনা, মায়া ও ইনকা সভ্যতা থেকে শুরু করে ক্লাসিক্যাল যুগের গ্রীক ও রোমান সভ্যতা এবং মধ্যযুগীয় সভ্যতা, এমনকি আজকের আধুনিক সভ্যতা—প্রতিটি সভ্যতার রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস। আর প্রতিটি ইতিহাসে ছিল কিছু আলাদা আলাদা নায়ক, যাঁরা সেই সময়ের সমাজ পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
এই সকল বিপ্লবী নায়কদের মধ্য থেকে কিছু বিপ্লবী বিশেষ করে মধ্যযুগ ও আধুনিক সভ্যতা অবদান আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।

প্রথম সভ্যতা:

মেসোপটেমিয়া সভ্যতা (Mesopotamian Civilization)
পৃথিবীর প্রথম সভ্যতা হিসেবে মেসোপটেমিয়া সভ্যতাকে বিবেচনা করা হয়। তখন থেকেই লিখিত ভাষা, সংস্কৃতি, আইন, প্রশাসন, ধর্মীয় কাঠামো, যুদ্ধ, প্রভাব বিস্তারসহ বহু কেন্দ্রিক রাজনীতি গড়ে উঠেছিল। এই সভ্যতার অনেক কাহিনি পরবর্তী ধর্ম, সংস্কৃতি ও রাজনীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।
যদিও আদম (আঃ) থেকে এই সভ্যতা গড়ে ওঠা পর্যন্ত সময়কালে চাতাল হিউয়ুক (Çatalhöyük) এবং জেরিকো (Jericho) — যেগুলো আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০০ থেকে ৬০০০ অব্দের—লোকজন কৃষিকাজ জানতো, গৃহপালিত পশু পালন করতো, তবে তাদের শহর-রাষ্ট্র বা লিখিত ভাষা ছিল না। এই সময়কে নিওলিথিক যুগ (New Stone Age) বলা হয়।
মেসোপটেমিয়ার নগররাষ্ট্র — যেমন: উর, উরুক, লাগাশ, কিশ, ব্যাবিলন, আসিরিয়া—এসব এলাকায় প্রায়ই যুদ্ধ লেগে থাকত।
উল্লেখযোগ্য কিছু সংঘাতের মধ্যে ছিল:

লাগাশ ও উম্মার মধ্যে যুদ্ধ
আসিরীয়দের যুদ্ধ ও দখলযুদ্ধ
আক্কাদীয় সাম্রাজ্য ও অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী নগরগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ। এসব যুদ্ধ ছিল নির্মম, ভয়াবহ এবং দীর্ঘস্থায়ী।

মেসোপটেমিয়া সভ্যতার বিখ্যাত শাসকেরা:
সারগন আক্কাদ (Sargon of Akkad):
মেসোপটেমিয়ার প্রথম সম্রাট যিনি আক্কাদীয় সাম্রাজ্য (Akkadian Empire) প্রতিষ্ঠা করেন (প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ২৩৩৪–২২৭৯)।

গিলগামেশ (Gilgamesh):
উরুক নগরীর রাজা, যার নামে বিখ্যাত মহাকাব্য “Epic of Gilgamesh” রচিত হয়। তাকে আধা-ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক চরিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

হাম্মুরাবি (Hammurabi):
ব্যাবিলনীয় রাজা, যিনি “Hammurabi’s Code” নামে প্রথম লিখিত আইন প্রবর্তন করেন।

এসব শাসকদের ছাড়াও প্রতিটি শহরভিত্তিক আলাদা রাজা থাকতো। তারা পরিচিত ছিল:
লুগাল (Lugal): অর্থ “বড় মানুষ” বা রাজা
এনসি (Ensi): অর্থ “প্রধান পুরোহিত” নামে।

মানুষের উপর মানুষের কর্তৃত্ব, অযৌক্তিক চাঁদা, জবরদখল, আর সামান্য বিষয় নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ। পরিস্থিতি এমন ছিল যে, যার শক্তি, তারই শাসন। দুর্বলরা নির্যাতিত হতে হতে নির্যাতনকেই তাদের ভাগ্যের পরিহাস হিসেবে মেনে নিয়েছিল।

এমন পরিস্থিতিতে মানুষকে মুক্তির পথ দেখানোর জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়াতের বাণী নিয়ে হযরত ইদ্রিস (আঃ) এবং পরবর্তীতে হযরত নূহ (আঃ)-এর আগমন ঘটে।
আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)-এর ঘনিষ্ঠ বংশধর ছিলেন হযরত ইদ্রিস (আঃ)। আদম (আঃ)-এর ইন্তেকালের পর অনেক মানুষ তাওহীদের সঠিক শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে এবং মিথ্যা, প্রতারণা, জুলুম, হত্যা ও অনৈতিক কর্মে লিপ্ত হয়ে যায়। এমনকি যারা নিজেদের দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত মনে করতো, তারাও নানা বিদআত ও কুসংস্কারে জড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে মূর্তিপূজার সূচনা হয় এবং তা ইদ্রিস (আঃ)-এর পরবর্তী যুগে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় লেখালেখির যে প্রাচীন নিদর্শনের কথা আমরা জানি, তার অন্যতম অগ্রদূত ছিলেন হযরত ইদ্রিস (আঃ)। শুধু তাই নয়, তিনি মানুষকে সেলাই ও পোশাক তৈরির কৌশল শেখান। এর আগে মানুষ পাতা বা পশুচর্ম দিয়ে শরীর আবৃত করত; ইদ্রিস (আঃ) কাপড় তৈরি করে তা পরিধানের রীতি চালু করেন।
তিনি জ্যোতির্বিদ্যার প্রাথমিক ধারণা দেন এবং সময় গণনার পদ্ধতিও প্রবর্তন করেন।
পথভ্রষ্ট ও দিকভ্রান্ত মানুষের মাঝে তিনি আলোর দিশা দেখান, জুলুম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং নৈতিকতা ও তাওহীদের পথে মানুষকে আহ্বান করেন। তাঁর ডাকে বহু মানুষ আল্লাহর পথে ফিরে আসে এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক সভ্য সমাজের ভিত্তি স্থাপিত হয়।

হযরত ইদ্রিস (আঃ)-এর প্রায় চার-পাঁচ প্রজন্ম পরে হযরত নূহ (আঃ)-এর আগমন ঘটে।
হযরত ইদ্রিস (আঃ) অবস্থান করতেন ব্যাবিলন অঞ্চলে, আর হযরত নূহ (আঃ) ইরাক অঞ্চলে বসবাস করতেন।
ইদ্রিস (আঃ)-এর দাওয়াতের ফলে যেসব মানুষ সঠিক পথে এসেছিল, সময়ের ব্যবধানে তাদের বংশধররা ধীরে ধীরে তাওহীদ থেকে বিচ্যুত হয়ে অবাধ্যতার পথে চলে যায়।
এই কারণেই হযরত নূহ (আঃ) তাঁর জাতিকে টানা ৯৫০ বছর তাওহীদের দাওয়াত দিলেও উল্লেখযোগ্য সাড়া পাননি। অধিকাংশ মানুষ তাঁর কথা অস্বীকার করে এবং অবাধ্যতায় লিপ্ত থাকে।

খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ সাল থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কয়েক হাজার বছরে ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তা একসময় বিলুপ্ত হয়ে যায়।
পবিত্র কুরআনের বক্তব্য ও ঐতিহাসিকদের মতামত থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, আল্লাহর নবী হযরত নূহ (আঃ) তাঁর জাতিকে সংশোধন ও হিদায়াতের পথে আনার জন্য বহু চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তারা তাঁর আহ্বানে সাড়া না দিয়ে বহু দেব-দেবীর পূজার উপর ভিত্তি করে একটি বহুদেববাদী (Polytheistic) সমাজ গড়ে তোলে। এমনকি প্রতিটি শহরের জন্য নির্দিষ্ট দেবতাও ছিল— যেমন: উরুক শহরের দেবী ‘ইনানা’ এবং নিনেভে শহরের ‘আশুর’।
সেই সময়ের রাজারা নিজেদের দেবতাদের প্রতিনিধি মনে করত, কিংবা অনেক সময় নিজেদের অর্ধ-দেবতা হিসেবে উপস্থাপন করত। মন্দিরগুলো ছিল শুধু ধর্মীয় উপাসনার স্থানই নয়, বরং প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার কেন্দ্রও।
পবিত্র কুরআনে হযরত নূহ (আঃ) ও আদ জাতির কথা বেশ কয়েক স্থানে উল্লেখ আছে— বিশেষ করে সুরা নূহ এবং সুরা শুআরার ১২৩ নম্বর আয়াত থেকে পড়লে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে।
আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে আদ জাতি সমগ্র মেসোপটেমিয়াকে এক ধর্মহীন, শোষণমূলক ও মূর্তিপূজক সমাজে পরিণত করেছিল। বহু শতাব্দী ধরে তাদের সতর্ক করার পরেও তারা সংশোধিত না হওয়ায়, আল্লাহ তাদেরকে ভয়াবহ প্লাবনের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছেন।

চলবে—-
বই -রক্তে লেখা ইতিহাস -লেখক আবু নাঈম মু শহীদুল্লাহ্


Share Option;

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *