ইউরোভিশন ডেস্ক:
কার্লাইল শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত স্কচ স্ট্রিট। এখানে ব্রিটিশ সমাজের নানা শ্রেণির মানুষের পাশাপাশি বাস করে ভারতীয়, বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি কমিউনিটি। ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট, টেইকওয়ে, গ্রোসারি দোকান, ওষুধের দোকান, এবং বেকারিগুলোতে কর্মরত বহু অভিবাসী।
তাদের কেউ কেউ রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী, কেউ বা মাত্র ছয় মাসের ভিজিট ভিসায় এসে বছরের পর বছর ধরে বসবাস করছে। এখানেই ছিল জনপ্রিয় Greggs Bakery যার সামনে দিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য মা-বাবা তাঁদের সন্তানদের হাত ধরে হেঁটে যেতো।
কিন্তু একদিন, এই দোকানেই ঘটে যায় এমন এক হত্যাকাণ্ড, যা কেবল একটি পরিবারের নয়, গোটা কমিউনিটির চেতনায় রক্তাক্ত ছাপ রেখে গিয়েছিল।
শাহজাহান মণ্ডল কবির। ১৯৯৬ সালে ছয় মাসের ভিজিট ভিসা নিয়ে কুষ্টিয়া থেকে যুক্তরাজ্যে আসেন। ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আত্মগোপন করে তিনি কাজ করতে থাকেন বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে। শেষমেশ তিনি থিতু হন কার্লাইলে।
একজন তান্দুরি শেফ হিসেব একটি রেষ্টুরেন্টে তিনি কাজ করার সময় এক প্রতিবেশী ব্রিটিশ তরুণীর সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। মেয়েটির নাম লরনা মার্টিন। সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতায় ১৯৯৯ সালে তারা বিয়ে করে একসঙ্গে বসবাস শুরু করেন। ২০০২ সালের ৬ ডিসেম্বর জন্ম নেয় তাদের এক পুত্র সন্তান। নাম রাখেন “হাসান”। কিন্তু স্বপ্নের সংসার ধীরে ধীরে রূপ নিতে থাকে তিক্ত দাম্পত্যে। মতানৈক্য, অভিযোগ, দুর্ব্যবহার সব মিলে এক পর্যায়ে তারা আলাদা হয়ে যান।
২০০৩ সালের এপ্রিল মাসে কবিরকে লরনার বাড়ি থেকে চলে যেতে বলা হয়। বিচ্ছিন্ন হলেও কবির নিয়মিত হাসানকে দেখতে যেতেন। কিন্তু সম্পর্কের টানাপোড়েনে সেই অনুমতি সীমিত হয়ে আসে। এক পর্যায়ে লরনা কবিরকে ছেলের সঙ্গে দেখা করতে দিতে অস্বীকৃতি জানান।
কবিরের ভিসার মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। ২০০৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনও খারিজ হয়ে যায়। সরকার জানিয়ে দেয়, তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। নিজেকে ভবিষ্যৎহীন ও পরিবারহীন মনে করতে শুরু করেন কবির।
২০০৩ সালের ২১ অক্টোবর। সকাল ১১টা ৫৫ মিনিট। স্কচ স্ট্রিটের Greggs Bakery-তে প্রবেশ করেন লরনা মার্টিন, তার মা পলিন মার্টিন, এবং শিশুপুত্র হাসান। হাসানের প্রথম জন্মদিন উদযাপনের জন্য কেক অর্ডার দিতে এসেছেন তারা। কিন্তু সেই উৎসবের মুহূর্তেই অন্ধকার নামিয়ে আনেন কবির।
তিনি আগে থেকেই ওঁৎ পেতে ছিলেন। প্লাস্টিক ব্যাগে পত্রিকার ভাঁজে লুকানো ছিল একটি ১২ ইঞ্চি লম্বা ছুরি। দোকানে ঢুকে তিনি প্রথমে চিৎকার করে ওঠেন, “আমি আমার ছেলেকে দেখতে চাই!”
তিনি লরনাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেন। লরনা উঠে দাঁড়িয়ে ছেলেকে আগলে ধরেন। ধস্তাধস্তি শুরু হয়। একপর্যায়ে ছেলের চিবুক ধরে কবির তার মাথা কাত করেন এবং ছুরি দিয়ে অবুঝ শিশুটির গলা কেটে ফেলেন। পুশচেয়ারে বসা অবস্থাতেই মৃত্যু হয় হাসানের।
ঘটনার পর কবির পালিয়ে যেতে চাইলে পথচারীরা তাকে ধরে ফেলেন। পুলিশ এসে তাকে গ্রেফতার করে। মর্মান্তিক এ ঘটনায় গোটা কার্লাইল শহর স্তব্ধ হয়ে যায়।
ঘটনার পর, Greggs দোকানের সামনে ফুল, টেডি বিয়ার, এবং নোট রেখে যান স্থানীয়রা। একটি নোটে লেখা ছিল: “হাসান, তুমি ছিলে এক অসাধারণ ছেলে।” লরনার আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা বলেন, “ও ছিল সদা হাস্যময় একটি শিশু, যে সবার মুখে হাসি এনে দিত।”
লরনার এক আত্মীয় বলেন, “আমরা শাহাজান কবিরকে পরিবারে জায়গা দিয়েছিলাম। কিন্তু সে আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এমন নিষ্ঠুরভাবে, যা কল্পনাও করা যায় না।”
আদালতে বিচার কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৪ সালের মে মাসে। কবির প্রথমে নিজের দোষ অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে স্বীকার করেন, তিনিই খুন করেছেন। তিনি দাবি করেন, তিনি বিষণ্ণতা ও মানসিক দুরবস্থার মধ্যে ছিলেন এবং আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন।
কোর্টে ফরেনসিক সাইকিয়াট্রিস্ট ড. ক্রিস্টোফার গ্রীন জানান, কবির একধরনের ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারে ভুগছিলেন, তবে তাকে মানসিক রোগী বলা যায় না।
জুরি বোর্ড কবিরকে হাসানের হত্যার দায়ে এবং লরনা ও পলিন মার্টিনকে গুরুতর জখম করার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে।
২২ জুলাই ২০০৪ সালে রায় ঘোষণা করা হয়। আদালত কবিরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। সাজার মেয়াদ শেষে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে।
হাসান ছিল একটি শিশুমাত্র। যার প্রাপ্য ছিল নিঃশর্ত ভালোবাসা, যার প্রাপ্য ছিল মায়ের বুকে নিরাপদ আশ্রয়। অথচ সেই কোমল জীবনের স্বাভাবিক অধিকার ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় অভিবাসনের অনিশ্চয়তা, দাম্পত্য কলহ আর এক পিতার মানসিক বিপর্যয়ের হিংস্র বিস্ফোরণে।
কবির শুধু একটি শিশুকে হত্যা করেনি; তছনছ করে দিয়েছে একটি পরিবার, স্তব্ধ করে দিয়েছে এক শহরের হৃদস্পন্দন। কার্লাইলের শান্ত আকাশ আজও যেন বহন করে সেই আর্তনাদ; এক পিতার হাতে শিশুপুত্রের নির্মম পরিণতির সাক্ষ্য হয়ে।
তথ্যসূত্র:
BBC News (২২ জুলাই ২০০৪)
The Guardian (২২ জুলাই ২০০৪)